সাইফুল ইসলাম:
অনলাইনে লাখ টাকার জাল নোট ২০ হাজারে বিক্রি
প্রায় অর্ধকোটি টাকার মূল্যমানের জাল নোটসহ হোতা মো. আমিনুল হক ওরফে দুলালসহ চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তারা হলেন- মোহাম্মদ আমিনুল হক ওরফে দুলাল (৪৩), আব্দুর রাজ্জাক ওরফে দিদার (৩০), মো. সুজন আলী (৪০) এবং মোহাম্মদ সাকিবুল হাসান (২১)। এ সময় তাদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার মূল্যমানের জাল নোট (যার মধ্যে ১০০০, ৫০০ ও ১০০ টাকা সমমানের জাল নোট), একটি ল্যাপটপ, একটি প্রিন্টার, ১১টি টোনার ও কার্টিজ, একটি পেনড্রাইভসহ জালনোট তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, চক্রটি প্রতি লাখ টাকা মূল্যের জাল নোট ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত। চক্রটি মাছ বাজার, লঞ্চ ঘাট, বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন মার্কেটে নানান কৌশল অবলম্বন করে জাল নোট সরবরাহ করত। সম্প্রতি গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব জানতে পারে, একটি প্রতারক চক্র প্রায় এক বছর ধরে জাল নোট তৈরি করে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে আসছে। এই চক্রটি জাল নোটের ব্যবসা করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। র্যাব প্রতারক চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল মঙ্গলবার রাতে র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর ডেমরা, সবুজবাগ ও খিলগাঁও এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জাল নোট তৈরি চক্রের সদস্যদের গ্রেফতার করে। আজ বুধবার (২৩ আগস্ট) দুপুরে কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, গ্রেফতার চক্রের সদস্যরা পরস্পর যোগসাজশে প্রায় এক বছর ধরে জাল নোট তৈরি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতারণার মাধ্যমে জাল নোট বিক্রি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। তারা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পেজ ও গ্রুপ থেকে জাল নোট তৈরি ও ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার আমিনুল সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমের একটি গ্রুপের মাধ্যমে গ্রেফতার অপর সদস্যদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
পরবর্তীতে গ্রেফতার আমিনুলের নেতৃত্বে কম সময়ে অল্প পুঁজিতে অধিক লাভের আশায় তারা জাল নোটের ব্যবসা করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথমে তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে এবং সেখানে তারা জাল নোট তৈরি/ব্যবসার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান করে। এই মেসেঞ্জার গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে দিদার কাজ করত বলে জানা যায়।
তিনি বলেন, গ্রেফতার আমিনুল জাল নোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় সে নিজেই এই চক্রটি পরিচালনা করত এবং সে নিজে ল্যাপটপ, প্রিন্টার, পেনড্রাইভ, কাগজ, টিস্যু পেপার ও প্রিন্টারের কালিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয় করে। গ্রেফতার আমিনুল জাল নোট প্রিন্টিং করে গ্রেফতার দিদারকে দিতো এবং গ্রেফতার দিদার চক্রের অপর সদস্য গ্রেফতার সুজনকে সঙ্গে নিয়ে জাল নোট কাটিং ও বান্ডিল করত।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, যখন জাল নোটের ব্যবসা রমরমা থাকে তখন চক্রটি দৈনিক ২-৩ লাখ টাকা মূল্যমানের জাল নোট তৈরি করত। মূলত তারা একটি অভিনব কায়দায় জাল নোটগুলো বিক্রি করত। তারা তাদের ফেসবুক গ্রুপ হতে কমেন্ট দেখে তাদের সঙ্গে মেসেঞ্জারে চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে ক্লায়েন্ট তৈরি করে অগ্রীম টাকা নিয়ে নিত এবং পরে তাদের সুবিধাজনক স্থানে জাল নোটগুলো সরবরাহ করতো।
তিনি আরও বলেন, এ চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তৈরিকৃত জাল নোট সরবরাহ করত। তারা প্রতি এক লাখ টাকা মূল্যের জাল নোট ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত। চক্রটি মাছ বাজার, লঞ্চ ঘাট, বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন মার্কেটে নানান কৌশল অবলম্বন করে জাল নোট সরবরাহ করত। এছাড়াও তারা অধিক জন-সমাগম অনুষ্ঠান বিশেষ করে বিভিন্ন মেলা, উৎসব, পূজা ও কোরবানীর পশুর হাট উপলক্ষে বিপুল পরিমাণ জাল নোট ছাপিয়ে ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জালনোট প্রিন্টিংয়ের সময় কাগজের অব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয় ফেলত। এ পর্যন্ত চক্রটি বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২ কোটি মূল্যমানের জাল নোটের ব্যবসা করেছে।
র্যাবের মুখপাত্র বলেন, গ্রেফতার আমিনুল রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতো। এ পেশার আড়ালে সে অনলাইনে জাল নোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে। পরে সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে তার অন্যান্য সহযোগীদের সঙ্গে পরিচয় হলে কম সময়ে অল্প পুঁজিতে অধিক লাভের আশায় তাদের সঙ্গে জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের একটি চক্র গড়ে তোলে। এরপর আমিনুল জাল নোট তৈরির সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করে এবং সে নিজে জাল নোট ডিজাইন এবং প্রিন্টিং এর কাজ করত। আমিনুল প্রায় এক বছর ধরে চক্রটি পরিচালনা করে আসছিল।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার আব্দুর রাজ্জাক ওরফে দিদার হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকত্তোর সম্পন্ন করে নিজস্ব গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করে। পরে ২০২১ সালে গার্মেন্ট ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় সে স্বল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘জাল নোট বিক্রি করি, জাল টাকা সেল, জাল টাকা বেচি’সহ বিভিন্ন জাল নোট ক্রয়-বিক্রয়ের পেজ ও গ্রুপে নিজেকে যুক্ত করে। সে চক্রের মূলহোতা গ্রেফতার আমিনুলের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করতো। পাশাপাশি জাল নোটগুলো প্রিন্ট করার পর আমিনুলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো কাটিং ও বান্ডেল করে তাদের মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে নির্বাচিত বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের কাছে সরবরাহ করত। গ্রেফতার সুজন ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে এলাকায় একটি জুতার দোকান পরিচালনা করতো। সে ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ঋণগ্রস্ত হওয়ায় ঢাকায় চলে আসে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জাল নোট তৈরি চক্রের আমিনুল ও দিদারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে চক্রের মূলহোতা আমিনুলের সহযোগি হিসেবে কাজ করতো। সে গ্রেফতার দিদারের সঙ্গে জাল নোটগুলো প্রিন্ট করার পর সেগুলো সংগ্রহ করে কাটিং এবং বান্ডেলের পর তাদের মেসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে নির্বাচিত বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের কাছে সরবরাহ করত। গ্রেফতার সাকিবুল রাজধানীর একটি মাদরাসায় পড়ালেখা করতো। পাশাপাশি সে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লায়েন্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখতো। এছাড়াও সে আমিনুলের সঙ্গে প্রিন্টিংসহ সকল কাজেই তাকে সহযোগিতা করত।