নিজেস্ব প্রতিবেদক:
কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। এসময় কোথাও বাস-ট্রাকে আগুন দেওয়া হয়েছে, কোথাও ভাঙচুর করা হয়েছে। দুর্বৃত্তদের আগুনের শিকার হয়েছে ট্রেনও। ফলে এখনো বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলাচল। এসব ঘটনায় সড়ক ও রেলের প্রায় ৪৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরদিন ১৬ জুলাই থেকে এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সমিতি আরও জানিয়েছে, সারা দেশে মোট অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে ৭৮টি গাড়িতে। এতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ঢাকাসহ সারা দেশে সর্বমোট ১২৫টি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৬২ লাখ টাকা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকাসহ সারা দেশে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের শিকার হয়েছে ২০৩টি গাড়ি। এতে সর্বমোট আনুমানিক ২৪ কোটি ৯২ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও মালিক সমিতি।
এত গেল দৃশ্যমান ক্ষতির হিসাব। এর বাইরে সারা দেশে গাড়ি চলাচল না করায় প্রতিদিন পরিবহন খাতে ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলেও জানিয়েছে সমিতিটি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক (ঢাকা) সফিকুল আলম খোকন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেটা ক্ষতি হয়ে গেছে সেটার চিন্তা-ভাবনা আমাদের নেই। সরকারও এখন নিজের অবস্থান নিয়ে ব্যস্ত। আমরা সরকারকে আমাদের ক্ষতির কথা জানাব। এর আগেও গাড়ি পোড়ানো হয়েছিল।
তিনি বলেন, এখন যা ক্ষতি হয়েছে তা মালিকদের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। সব কিছু মিলে প্রতিদিন পরিবহন খাতে গড়ে মিনিমাম ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রেলওয়ের ক্ষতি
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সড়ক পরিবহনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়েও। নিরাপত্তার স্বার্থে সারা দেশে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলাচল করছে তেলবাহী ও কন্টেইনারবাহী ট্রেন।
আন্দোলনের মধ্যে গত ১৯ জুলাই ঢাকায় আসার পথে নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয় কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস। ট্রেনের তিনটি কোচে আগুন দেয় তারা। মুহূর্তেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নতুন কেনা তিনটি কোচ। এতে রেলওয়ের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়াও সেদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হামলা করা হয় সোনার বাংলা, কক্সবাজার, পারাবত এক্সপ্রেসসহ বেশ কয়েকটি ট্রেনে। এতেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশ কয়েকটি কোচ।
১৯ জুলাই রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হলে বন্ধ হয়ে যায় ট্রেন চলাচল। এতে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়ে রাষ্ট্রীয় এই পরিবহন খাত। এদিকে ১৯ থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সময়ের বিক্রি হওয়া ট্রেনের টিকেটগুলোর টাকা ফেরত দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে রেলওয়ে। রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ জানিয়েছে, ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকলে প্রতিদিন অন্তত ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা ২২ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করেছি। বিভিন্ন জায়গায় সিগনালিং ব্যবস্থার সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেনে আগুন দেওয়া, বিভিন্ন ট্রেনের জানালার কাচ ভেঙে দেওয়াসহ বেশ কিছু কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তার জন্য চলাচলরত অবস্থায় ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোচ, ইঞ্জিন, ইলেকট্রিক সিস্টেম যেহেতু কয়েকদিন বন্ধ রয়েছে, এসব ছোটখাটো পরীক্ষা আমরা অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারব। ট্রেন চলাচলের সিদ্ধান্ত পাওয়া গেলে আমরা নিরাপত্তার সাধারণ প্রস্তুতি শেষে অল্প সময়ের মধ্যেই ট্রেন চালাব।
অন্যদিকে রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম বলেছেন, ট্রেন না চলার কারণে টিকিট রিফান্ড করতে হচ্ছে। এটা সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এখন পর্যন্ত ১৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার বেশি টিকিট রিফান্ড করা হয়েছে যাত্রীদের। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলিয়ে রেলওয়ের মোট ক্ষতি হয়েছে ২২ কোটি ৩ লাখ ৮ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, হামলাকারীরা কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের তিনটি কোচে আগুন দিয়েছে। এ ছাড়া সোনার বাংলা, কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পারাবত এক্সপ্রেসের বিভিন্ন কোচে হামলা করে ভাঙচুর করেছে। বিভিন্ন স্টেশনে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ, সিগন্যাল ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে রেললাইন উপড়ে ফেলার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। সারা দেশে কয়েকটি জায়গায় ট্রেনে ও স্টেশনে রাখা বিভিন্ন যন্ত্রাংশে হামলা করা হয়েছে। এ কারণে এখনো ট্রেন চালানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। পরিস্থিতি বুঝে ট্রেন চলাচলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
রেলমন্ত্রী বলেন, রেলের ইঞ্জিন ও কোচের সংখ্যা কম। তারপরও রেলওয়ে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে ট্রেন পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে চলাচল করবে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা হয়েছে। রেলওয়ে চাইছে না যে এমন কিছু হোক যাতে আবার আগুনের মধ্যে ঠেলে দিতে হয়। প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করবে রেল চলাচল।
কোটা নিয়ে কী জটিলতা ছিল?
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিসিএসসহ সব ধরনের সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার প্রচলন ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ৫৬ জন নিয়োগ দেওয়া হতো কোটাধারী চাকরিপ্রার্থীদের মধ্য থেকে। এটাকে ‘বৈষম্য’ উল্লেখ করে এর নিরসনে বিভিন্ন সময় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালে হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলন ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘বিরক্ত হয়ে’ একদিন সংসদে ঘোষণা করেন, যেহেতু কেউ কোটা চায় না সুতরাং এখন থেকে আর কোনো কোটা থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার পর ওই বছরই প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার।
এরপর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার আবারও প্রচলন চান। হাইকোর্ট ওই রিট ‘অ্যাবসোলুট’ ঘোষণা করেন এবং ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে জারি করা সরকারি পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলে যায়। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা জারি করেন। আগামী ৭ আগস্ট এ বিষয়ে চূড়ান্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
তবে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ২১ জুলাই শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালতের রায়ে কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করা হয়। একইসঙ্গে সরকারের নীতি নির্ধারণী বিষয় হলেও সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালত সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ মেধাভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দেন। আর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ কোটা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয় রায়ে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য এক শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য এক শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ওই আদেশের আলোকে গত ২৩ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে সব গ্রেডে এখন থেকে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হবে ৯৩ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ নিয়োগ হবে কোটার ভিত্তিতে। তবে, কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে সাধারণ মেধাতালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে।