আমলাতন্ত্র :ভাবনা ও বাস্তবতা

প্রকাশিত: ১২:৪৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০২৫


নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

ছোটবেলায় ‘আমলাতন্ত্র’ শব্দটির অর্থ সেভাবে বুঝতাম না। বড় হতে হতে বুঝলাম তারা সরকারি চাকরি করা বড় বড় পদবি ও ক্ষমতাধারী মানুষ। তাদের কাছে সাধারণ মানুষ সহজে ভিড়তে পারে না বললেই চলে। সব সময় একটা অদৃশ্য প্রাচীর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের কাছ থেকে তাদেরকে বিস্তর দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করে।

ফলে তাদের নিয়ে যখনই কথা বলা হয় বা কোনো আলোচনা হয়—বাঙালি তাদের চিরায়ত সমালোচনার অভ্যাসগত চর্চার ধারাবাহিকতায় আমলাদেরকে সব সময় নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতেন। কিন্তু এ সম্পর্কিত অনেক ধারণাই পালটে গেল বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের ‘ব্যুরোক্রেসি’ পড়তে গিয়ে এর আদ্যপান্ত বোঝার কিছুটা সুযোগ পেলাম। মহত্ পেশাগত উদ্দেশ্য সাধনের কল্যাণকর ব্রত নিয়েই এই ‘আমলাতন্ত্র’ শব্দটির সৃষ্টি।

‘আমলা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন। শব্দগতভাবে তাই যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারের আদেশ পালন ও বাস্তবায়ন করেন তাদেরকে আমলা বলে। আমলাদের সংগঠনকে বলে ‘আমলাতন্ত্র’। অন্যদিকে আমলাতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ ইঁৎবধঁপৎধপু, তবে ফরাসি ব্যুরো (ইঁৎবধঁ) এবং গ্রিক ক্রেটিন (কৎধঃবরহ) শব্দ থেকে ব্যুরোক্রেসি (ইঁৎবধঁপৎধপু) শব্দের উদ্ভব ঘটেছে। ব্যুরো শব্দের অর্থ লেখার টেবিল এবং ক্রেটিন শব্দের অর্থ শাসন। সুতরাং উত্পত্তিগতভাবে আমলাতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে উবংশ এড়াবৎহসবহঃ বা দপ্তর সরকার। আক্ষরিক অর্থে আমলাতন্ত্র বলতে আমলা বা প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের শাসন বোঝায়। আমলাতন্ত্র হচ্ছে স্থায়ী, বেতনভুক্ত, দক্ষ ও পেশাদার কর্মচারীদের সংগঠন।

আমলাতন্ত্রের আধুনিক আলোচনার অগ্রনায়ক প্রখ্যাত জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েবারের কথা আগেই বলেছি। তিনি প্রথম আমলাতন্ত্রকে একটা আইনগত ও যুক্তিসংগত মডেল হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং তিনিই আদর্শ আমলাতন্ত্রের উদ্ভাবক। তার মতে, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীবৃন্দ বা আমলা হচ্ছেন সুদক্ষ, পেশাদারী, অরাজনৈতিক, স্থায়ী এবং অধীনস্থ কর্মকর্তা। তিনি তার লেখায় আরো বলেছেন, আমলাতন্ত্র অসংখ্য ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে ও জটিল শর্তে সুশৃঙ্খলভাবে পরস্পর একত্র হওয়াকে বোঝায়। তার এই ধারণাকে গ্রহণ করে অধ্যাপক ফিফনার এবং প্রেসথাস বলেন— ‘আমলাতন্ত্র হলো বিভিন্ন ব্যক্তি এবং তাদের কার্যাবলিকে এমন একটা পদ্ধতিতে সংগঠিত করা, যা সুসংহতভাবে গোষ্ঠী শ্রমের উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হয়, যার মূল লক্ষ্য দেশের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষকে সংগঠিতভাবে সেবা প্রদান করা এবং তাদের উন্নয়নে এগিয়ে আসা।’ অর্থাত্ সবার মহত্ পেশাগত উদ্দেশ্য সাধনের কল্যাণকর ব্রত নিয়ে আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি এবং শুরু থেকেই আমলারা তার নিজস্ব কর্মগুণ ও পেশাগত দক্ষতার মাধ্যমে জনসাধারণের সামগ্রিক মান উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করবেন সম্পূর্ণভাবে পেশাদারী ও অরাজনৈতিক মনোভাব নিয়ে—এটাই হলো সারকথা। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে এমন ধারণার অনেক ইতিবাচক প্রয়োগ দেখলেও আমাদের দেশের বাস্তবতায় আমরা কী দেখতে পাই? এখানে আমলাদের বিষয়ে কার্ল মার্ক্স প্রদত্ত মন্তব্যই যেন অনেকখানি যুক্তিযুক্ত। তিনি বলেছিলেন—‘নিজেদের নাককেই তারা কর্তব্যের অস্ত্র মনে করেন এবং সব ব্যাপারেই সেসব অস্ত্রের প্রয়োগ ঘটান। এই নাক গলানোর কর্মকাণ্ডই তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ এবং নিয়মের অর্থ।’

এখানে আমরা যা দেখতে পাই, আমলাতন্ত্রের শিকড়ে ঢুকে পড়েছে ব্যাপকভাবে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি। কমবেশি সব সময়ই তার দৌরাত্ম্য থাকলেও এই মাত্রা চরম ভয়াবহ আকার ধারণ করে বিগত দেড় দশকে। এর মধ্যে রাজনৈতিক আনুগত্যের গরল ও শক্তিশালী বিষ ঢুকিয়ে একে মারাত্মকভাবে কলুষিত করা হয় দিনের পর দিন। ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ ছদ্মবরণে সামগ্রিক সিভিল-সংস্করণের এই যুগে স্বার্থবাদী ও সুযোগসন্ধানী বিভিন্ন আমলা পেশাদারিত্বকে পাশ কাটিয়ে চরম দলীয় আনুগত্য ও অপেশাদারী চরিত্রে অবতীর্ণ হতে থাকে। আর এর ফল হিসেবে পেশার প্রতি ‘আনুগত্যশীল’ ও ‘অনুভূতিশীল’ নামক যোগ্যতাগুলো চরমভাবে নিষ্পেষিত হতে শুরু করে এবং ক্রমান্বয়ে সে জায়গাগুলো দখল করে নেয় ‘দলের প্রতি’ অতি আনুগত্যশীল ও অনুভূতিশীল নামক যোগ্যতাসমূহ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এই সুযোগে অযোগ্য বা কম যোগ্যতাসম্পন্ন আমলারা বারবার পদোন্নতি নিয়ে তরতর করে সিনিয়রদের ডিঙিয়ে ওপরে উঠে যেতে শুরু করে। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাদের বড় একটি অংশ রাজনৈতিক নেতাদের মতো বক্তব্য দেওয়া শুরু করে, কথা বলে বা আচরণ করে। যারা তাত্ত্বিকভাবে আমলা বৈশিষ্ট্য ধারণ ও প্রতিপালন করেন, রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থের বাইরে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেন, তাদের প্রতিটা পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের অনেকের অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ, অনেক সৃষ্টিশীলতা অঙ্কুরেই দম হারায়। বিভিন্ন কালিমা দিয়ে তাদের এগোনোর পথ রুদ্ধ করা হয়। পদোন্নতি তো দূরের কথা— উপরন্তু যেসব পরিণতি গ্রহণ করতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া, ওএসডি করা অথবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অকর্মণ্য প্রমাণ করতে বসিয়ে রাখা ইত্যাদি। সব শাসনামলেই যেন এই দুষ্টচক্র থেকে কেউ বের হয়ে আসতে পারছে না, বরং সেই একই প্রক্রিয়া যেন সবার মধ্যে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।

বিশেষ করে, ক্ষমতাসীন দলের প্রতি অতি চরম আনুগত্যশীল ও পক্ষপাতদুষ্টতার ফলে এই সমন্বিত প্রতিষ্ঠানের আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলি আক্ষরিক অর্থে যেন দলীয় মিশন-ভিশন বাস্তবায়নে অনেকখানি বদ্ধপরিকর, পেশাদারিত্বের প্রসঙ্গটি এখানে তাই দীপ্তিহীন, অনুজ্জ্বল। এতে তাদের দলীয় আনুগত্য পেশাদারিত্বের প্রতি দায়িত্ব পালনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাতেও কোনো সমস্যা ছিল না, যদি তারা পেশাটাকে সেরকম মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে নিতে সমর্থ হতেন। অবস্থাদৃষ্টে এটা সুস্পষ্ট যে, স্বাধীনতা-পরবর্তী কোনো শাসনামলেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেটা হয়নি।

শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় : ‘আমরা যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা এই সমস্ত জঘন্য কাজকে ঘৃণা করি। খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব তাঁর মন্ত্রীত্বে একজন সরকারী আমলাকে গ্রহণ করলেন, এরপর আমলাতন্ত্রের প্রকাশ্য খেলা শুরু হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে। একজন সরকারী কর্মচারী হলেন গভর্নর জেনারেল, আরেকজন হলেন অর্থমন্ত্রী। খাজা সাহেব ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির লোক। তিনি অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন, তবে কর্মক্ষমতা এবং উদ্যোগের অভাব ছিল। ফলে আমলাতন্ত্র মাথা তুলে দাঁড়াল। আমলাতন্ত্রের জোটের কাছে রাজনীতিবিদরা পরাজিত হতে শুরু করল।’ শেখ মুজিবুর রহমানের সেই উপলব্ধি এখনো যেন সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে।

ঘটনার পরম্পরায় বিষয়টা এখন এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, আমলাতন্ত্র যেন আমাদের দেশে সহজকে কঠিন করে তোলার একটা শিল্প। এটা হলো সেই খেলা, যেখানে সবাইকে গোল হয়ে দাঁড়াতে হয়। খেলার শর্তটাই এমন যে, কিছু করবেন তো ধরা খাবেন। তাই কেউ কিছু করে না, খেলা চলতে থাকে। আর এই খেলার অবধারিত ফল হিসেবে দেখতে পাই শুধুই দুর্নীতি, অনিয়ম, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ইত্যাদি। আর একারণেই তাদের অনেকেই নিজেদের স্বার্থকেই জাতীয় স্বার্থ মনে করে, জাতীয় স্বার্থ তো তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার বাজি। সেই বাজিতে তারা জিতলে দেশ জেতে না, আর দেশের জয় মানে তাদের হার। তাই তো এর ফল হিসেবে আমলাতন্ত্রের চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে সাধারণ জনগণের দুঃখ-কষ্টের নানারকম প্রকাশের ভেতর দিয়ে। আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার দাপটের ক্ষেত্রে আদালত ও প্রশাসন তথা কোর্টকাচারি থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরগুলোর ইট-কাঠ-বারান্দা তার নীরব সাক্ষী। এরও কি গুণগত সংস্কার হবে না?