ডেস্ক রিপোর্ট:
গাজায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হাতে দেড় মাসেরও বেশি সময় জিম্মি থাকার পর গত ২৪ নভেম্বর কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির আওতায় বেশ কয়েকজন ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পান। মুক্ত হওয়া এসব জিম্মিরা শারীরিকভাবে মুক্ত হলেও মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়েছেন। সশস্ত্র যোদ্ধাদের হাতে জিম্মি হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত যেসব ভয় ও শঙ্কায় তাদের দিন কেটেছে, সেসব ভুলে স্বাভাবিক হতে পারছেন না অনেকেই। বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স।
মুক্ত হওয়া জিম্মিদের পরিবার রয়টার্সকে জানিয়েছে, বন্দিদশায় ইসরায়েলি নারী ও শিশুরা মারধরের শিকার হয়েছেন। এমনকি পেয়েছেন প্রাণনাশের হুমকিও। তাদেরকে ক্রমাগতই যখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো হতো, প্রতিবারই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় ও শঙ্কায় তাদের হৃদয় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত। অচেনা অজানা স্থানে সারাদিন অলস সময় কাটাতে হয়েছে তাদের। এমনকি শব্দ করে কথাও বলা যেতো না। বাধ্য হয়ে আনমনে ফিসফিস করার অভ্যেস হয়ে গেছে অনেকের, যাদের কথা মুখে কান লাগিয়েও বুঝতে পারেন না স্বজনরা।
রয়টার্স জানিয়েছে, গত ২৪ নভেম্বর থেকে ইসরায়েল ও হামাসের সমঝোতায় শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির চুক্তির আওতায় যেসব ইসরায়েলি জিম্মি মুক্তি পেয়েছেন, মানসিক স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে তাদেরকে গণমাধ্যম থেকে দূরে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তাই কোনও স্বাধীন যাচাই ছাড়াই মুক্তি পাওয়া এসব জিম্মিদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
হামাসের বিরুদ্ধে জিম্মিদের মারধরের অভিযোগ
ডেবোরা কোহেন নামে এক ব্যক্তি ফ্রান্সের বিএফএম টিভিকে বলেন, অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে ওইদিন তার ১২ বছর বয়সী ভাতিজা ইতান ইয়াহলোমিকে জিম্মি করে হামাস গাজায় নিয়ে গেলে, গাজার বাসিন্দারা তাদের মারধর করেন। এমনকি ইতানকে অপহরণকারীরা তাদের সহিংসতার ফুটেজ দেখতেও বাধ্য করে। তিনি আরও বলেন, সেখানে ভয় পেয়ে যতবারই কোনও শিশু কান্না করত, তাদের শান্ত করার জন্য অস্ত্র দেখিয়ে হুমকি দিত হামাসের যোদ্ধারা।
তবে বরাবরই জিম্মিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করার দাবি করে আসছে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। তাদের দাবি, জিম্মিদের জীবন ও সুস্থতা রক্ষায় তাদের সঙ্গে ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক মানবিক আচরণ করছেন তারা।
তবে জিম্মি করা কিছু ইসরায়েলি নিহত হওয়ার বিষয়ে হামাস বলছে, ৭ অক্টোবরে তাদের বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের করা পাল্টা হামলায় ওইসব ইসরায়েলি জিম্মি নিহত হন।
হুশশশৃফিসফিস করে কথা বলা
বন্দিদশায় থেকে ইসরায়েলে ফিরে আসা দুই মেয়ে এমিলি হ্যান্ড ও হিলা রোটেম শোশানি যাদেরকে গাজায় একসঙ্গে রাখা হয়েছিল। তাদের পরিবার জানিয়েছে, তাদের মেয়েরা দেশে ফিরে আসার পর থেকে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারছে না। তারা শুধু ফিসফিস করে কথা বলছে।
৯ বছর বয়সী এমিলি হ্যান্ডের বাবা থমাস হ্যান্ড মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘ওর কথা শুনতে আমাকে ওর মুখের কাছে কান পেতে থাকতে হয়েছিল। জিম্মি অবস্থায় ওকে কোনও প্রকার শব্দ করতে নিষেধ করা হয়। আপনি দেখেন, তার চোখে-মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক।’
ফিরে আসার পর এমিলিকে, হামলায় তার মা নারকিসের মৃত্যুর খবর জানানো হয়। এই সংবাদ শোনার পর এমিলির প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে ওর বাবা থমাস বলেন, গত রাতে কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমি ওকে থামাতে পারিনি। ও কোনও সান্তনা চাইছিল না। আমার ধারণা, নিজেকে কীভাবে সামলাতে হয় ও তা ভুলে গেছে। কাপড়ে নিজেকে লুকিয়ে চুপিচুপি নীরব কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ও।
এমিলির সঙ্গে থাকা অপর মেয়ে ১৩ বছর বয়সী হিলা রোটেম শোশানির ব্যাপারে তার চাচা ইয়ার রোটেম জানান, তিনি যখন হিলাকে আনতে যান তখন তার ভাগ্নী এমিলির হাত ধরেছিল। সেও এমিলির মতো ফিসফিস করে কথা বলছে। গাজায় ছেড়ে আসার সময় তার মা রায়াকে আলিঙ্গন করতে চায় হিলা। ইসরায়েলে ফেরত পাঠানোর জন্য হিলাকে জন্য তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করা হয়, তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তার মা রায়। তিনি এখনও গাজায় হামাসের জিম্মিতে রয়েছেন।
প্রাণনাশের হুমকি
মুক্তি পাওয়া আরেক জিম্মি শিশু ওহাদ। তার চাচা মেরাভ মোর রভিভ বলেন, আমার চাচাতো ভাই কেরেন মুন্ডার, কেরেনের নয় বছর বয়সী ছেলে ওহাদ এবং মা রুথ হিব্রু ভাষায় কথা বলেন। অপহরণকারীরা মাঝে মাঝে তাদের গলায় আঙুল দিয়ে এমন ইশারা করতেন যেন পান থেকে চুন খসলেই তাদের মেরে ফেলা হবে।
ইসরায়েলের চ্যানেল টুয়েলভকে মেরাভ মোর আরও বলেন, তাদেরকে ভূমি থেকে ভূগর্ভের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরানো হয়। সেখানে তারা খাবার হিসেবে বেশিরভাগ দিন শুধু ভাত আর রুটি বা পিঠা পেতো। পর্যাপ্ত খাবারের অভাবে তাদের ওজন কমে গেছে।
‘আর কয়েক ঘণ্টা দেরী হলেই আমরা তাকে চিরতরে হারাতাম’
ইসরায়েলি হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, গাজায় পুষ্টিহীনতায় ভুগেছেন এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত এমন জিম্মিদের অনেকেই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন।
হাসপাতালের কর্মীদের মতে, রবিবার (২৬ নভেম্বর) মুক্ত হওয়া জিম্মিদের একজন ৮৪ বছর বয়সী এলমা আব্রাহাম, যিনি ‘মৃত্যুর মুখে’ ছিলেন। এলমার মেয়ে টালি আমানো বলেন, তারা মাকে ভয়ানক অবস্থায় আটকে রেখেছিল। আর কয়েক ঘণ্টা দেরী হলেই আমরা তাকে চিরতরে হারাতাম।
হাতকড়া পরিয়ে, চোখ বেঁধে রেডক্রসের কাছে হস্তান্তর
৮৫ বছর বয়সী ইয়োচেভেদ লিফশিটজ গত ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে অপহৃত হন এবং এর ঠিক দুই সপ্তাহ পরেই মুক্তি পান। মঙ্গলবার রাতে হিব্রু ভাষার সংবাদপত্র দাভারকে তিনি বলেন, জিম্মি অবস্থায় তিনি হামাস প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এসময় তিনি হামাস প্রধানকে জিজ্ঞাসা করেন, তার মতো (ইয়োচেভেদ) শান্তি কর্মীদের বিরুদ্ধে এমন সহিংস আচরণ করায় তিনি কীভাবে লজ্জিত নন। তবে ‘তিনি কোনও জবাব দেননি। তিনি নীরব ছিলেন।’
আহল বেসোরাই সিএনএনকে জানান, তার ভাগ্নি ১৩ বছর বয়সী আলমা এবং ভাগ্নে ১৬ বছর বয়সী নোমকে এক নারী এসে নিয়ে যান। তারা ভেবেছিল তাদের টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সশস্ত্র যোদ্ধারা ‘তাদের হাতকড়া পরিয়ে, চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে করে রেড ক্রসের কাছে হস্তান্তর করে।’
পুনর্মিলনের আকাঙ্ক্ষা
ড্যানিয়েল অ্যালোনি নামে এক ইসরায়েলি মা তার মেয়ে এমিলিয়ার সঙ্গে হামাস সদস্যদের মানবিক আচরণের জন্য একটি চিঠি লিখে হামাসের সশস্ত্র আল-কাসাম ব্রিগেডকে ধন্যবাদ। আরবি মিডিয়ায় তাদের এ গল্প ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
ড্যানিয়েল তার মেয়ে এমিলিয়াকে মিষ্টি ও ফলমূল দেওয়ার জন্য এবং তার মেয়েকে রানির মতো রাখার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
তিনি লিখেন, ‘আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব যে, এখান থেকে চলে যাওয়ার সময় ও কোনও মানসিক ট্রমা নিয়ে যায়নি।’ তিনি আরও লিখেছেন, এই পৃথিবীতে যদি আমরা সত্যিই ভালো বন্ধু হতে পারতাম।
অ্যালোনির লেখা এই চিঠির বিষয়ে মন্তব্যের জন্য আলোনি বা তার পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারেন রয়টার্স।
ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হওয়া মানুষেরা ‘আসলে অসুস্থ নন’
ইসরায়েল সাইকোট্রমা সেন্টারের এমইটিআইভি-এর পরিচালক ড্যানি ব্রম বলেছেন, বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে কারও কারও চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সবারই চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন পড়বে এমন না। অনেকের আবার কাউন্সিলিংয়ের দরকার। মূল যে সমস্যাটি পুনরুদ্ধার করা দরকার তা হলো আবেগের নিয়ন্ত্রণ।’
ব্রম বলছিলেন, কোনও ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হওয়া মানুষেরা ‘আসলে অসুস্থ নন’। তাদেরকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। আর এর জন্য তাদের স্থান, সময় এবং সবচেয়ে বড় কথা একটি সুন্দর অনুকূল পরিবেশ পেতে হবে। তবে তার মানে এই না যে অযথাই তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করে রাখতে হবে।