নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশে ইমার্জিংটোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট) এর ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক তরুণের কাছে ইলেকট্রনিক সিগারেট এখন ফ্যাশন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
মূলত তরুণ এবং শিশুদের টার্গেট করে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এসব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো। ‘ধূমপানের আসক্তি দূর করতে ই-সিগারেটের ব্যবহার’-এমন প্রচারণার কারণেই দেশে গত কয়েক বছরে ই-সিগারেটের প্রতি ঝুঁকছে তরুণ-সমাজ। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাক পণ্যের জনপ্রিয়তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ইতোমধ্যে ৩২টি দেশ ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং পণ্য নিষিদ্ধ করেছে।
ডাব্লিউএইচও’র ২০২১ সালের তথ্যমতে, বাজারে ১৬,০০০ ধরনের স্বাদ/গন্ধযুক্ত (ফ্লেভার) ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বেশকিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে আমেরিকায় স্কুল পড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। হাইস্কুল পড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে কারণ এসব স্বাদ বা গন্ধ তাদের পছন্দ।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির গবেষণা সেল ‘টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ’ সেলের (টিসিআরসি) গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে তরুণদের আকৃষ্ট করতে ই-সিগারেট দোকানগুলো বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক গড়ে তোলা হয়েছে। তরুণদের আকৃষ্ট করতে তারা অবৈধভাবে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপন তৈরি করছে। ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। এ ছাড়া তারা তাদের নিজস্ব কিছু চিকিৎসকের মাধ্যমেও যারা ধূমপান ছাড়তে চায়, তাদের প্রচলিত সিগারেটের বদলে ই-সিগারেট ব্যবহারে উৎসাহিত করছে।
২০২০ সালে ঢাকা আহসানিয়া মিশন পরিচালিত ঢাকা শহরের কয়েকটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, তারা বেশির ভাগই জানেন না ই-সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ই-সিগারেটের বিভিন্ন ফ্লেভারের কারণে তরুণরা সহজেই এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, ই-সিগারেটে অ্যাসিটালডিহাইড (সম্ভাব্য কার্সিনোজেন), ফরমালডিহাইড (পরিচিত কার্সিনোজেন), অ্যাক্রোলিন (টক্সিন) এবং নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিসার মতো ধাতুসহ কমপক্ষে ৮০টি ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী (৬৫ শতাংশ) স্বাদের কারণে ই-সিগারেট ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন। স্টাইলের কারণে অনেকে ই-সিগারেট ব্যবহার করছেন বলেও জানা যায়।
জানাগেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে, যেখানে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এ ধরনের সব পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবনায় ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কেউ আইনের ধারা লঙ্ঘন করলে অনূর্ধ্ব ছয় মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। পাশাপাশি, যেকোনো ব্যক্তির জন্য এসব পণ্যের ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদন্ডের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ববলেছেন, ‘ইতোমধ্যে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।দেশে ই-সিগারেটের ব্যবসা করতেদেওয়া হবে না-এ বিষয়ে শক্ত অবস্থানে আছি।’
তামাকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে তিনি বলেন, তামাকের কারণে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়, মৃত ব্যক্তির পরিবারের অর্থনীতির ওপরে অন্ধকার নেমে আসে। সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবায় ক্ষতি হচ্ছে। অসংক্রামক ব্যাধি ক্যানসার, কিডনি ফেইলিয়ার-এগুলো অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তামাকজনিত কারণে এসব বেশি হয়ে থাকে।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির টোব্যাকো কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ সেলের (টিসিআরসি) সভাপতি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি বলেন, ‘১৫৩ জন এমপি ই-সিগারেট বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন। ই-সিগারেট বন্ধে এখনই কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।’
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ই-সিগারেটকে ধূমপান ছাড়ার জন্য ব্যবহার হয়। শুধুমাত্র যারা ছাড়তে চায় তারা এটা ব্যবহার করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এখন এটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। অসংখ্য তরুণ ছেলে-মেয়ে ই-সিগারেটের মাধ্যমে ধূমপান জগতে প্রবেশ করছে।
তিনি বলেন, একটা ছেলে যখন ই-সিগারেটের মাধ্যমে প্রথম প্রথম নিকোটিনে আসক্ত হবে, কখনও হয়তো এটাই নিয়মিত ব্যবহার করবে। অন্যথায় সে সিগারেট বা অন্য নেশার দিকে আসবে। এর জন্য আমরা বলি, আমাদের দেশে যেহেতু এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, সেহেতু এটাকে রোধ করা দরকার। এজন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ যেভাবে এটাকে নিষিদ্ধ করেছে সেভাবে আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ করা দরকার।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ই-সিগারেট সিগারেটের মতই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এটা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে। ই-সিগারেটের কারণে ক্যান্সারসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। চিন্তা শক্তি কমে যেতে পারে। তরল নিকোটিনযুক্ত ই-সিগারেট আমাদের যুব সমাজ বেশি ব্যবহার করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইন করে এটি বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের দেশেও আইন করে এটিকে বন্ধ করতে হবে।