উপজেলা পরিষদের ভোটে এমপিদের ট্রাম্পকার্ড ইউপি চেয়ারম্যানরা

প্রকাশিত: ১০:৪০ পূর্বাহ্ণ, মে ১২, ২০২৪

মোঃ সাইফুল ইসলামঃ 

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদের ভোটে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা। বিশেষ করে এমপিদের ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছেন তারা। এমপিরা তাদের সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ইউপি চেয়ারম্যানদের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন। ঐ ইউপি চেয়ারম্যানরা মেম্বারদের সঙ্গে নিয়ে এমপির প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন এবং করছেন। গত ৮ মে প্রথম ধাপের ইউপি ভোটের পর একাধিক পরাজিত প্রার্থী এসব তথ্য জানিয়েছেন।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ২১ জুন থেকে সাত ধাপে সাড়ে ৪ হাজার ইউপির ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ইউপির নিয়ন্ত্রণ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা জোট নির্বাচন বর্জন করেছিল। ঐ নির্বাচনে তিনটি পদে ১ হাজার ৬৯৮ জন বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের নৌকা প্রতীক নিয়ে ৩৬৮ জন ভোট ছাড়াই ইউপি চেয়ারম্যান হন। ঐ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন ২ হাজার ৫৩৮ জন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহীরা জয়ী হন ৯১১ জন। এর বাইরে স্বতন্ত্র জয়ী হন ৩১৩ জন এবং বিএনপি সমর্থিত ৩৪৯ জন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের একক নিয়ন্ত্রণ এখন ক্ষমতাসীনদের হাতে। সাধারণত ইউপি চেয়ারম্যানদের এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন স্থানীয় এমপিরা।

স্থানীয় সরকার (উপজেলা) নির্বাচনি আচরণবিধি অনুযায়ী, ইউপি চেয়ারম্যানদের নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় কোনো বাধানিষেধ নেই। ফলে চেয়ারম্যানরা এমপির প্রার্থীর পক্ষে সংশ্লিষ্ট ইউপিগুলোয় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। তাছাড়া ইউপি চেয়ারম্যানদের এমপির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা স্থানীয় এমপিদের সংশ্লিষ্ট সংসদীয় আসনের অভিভাবক বলা হয়ে থাকে। সবকিছুর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকেন এমপিরা। আগামী বছরের শেষে অথবা ২০২৬ সালে ইউপি নির্বাচন শুরু হবে। ঐ নির্বাচনে ইউপি চেয়ারম্যানদের ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্বেও থাকবেন এমপিরা। অতএব এমপি-মন্ত্রীদের ভোটের প্রচারণায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা সুকৌশলে ইউপি চেয়ারম্যানদের ভোটের মাঠে নামিয়েছেন।

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দলীয়ভাবে প্রার্থী না দেওয়ায় ভোটের মাঠের একক নিয়ন্ত্রণ এমপিদের হাতে। বিএনপি-জামায়াত ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। বেশির ভাগ উপজেলায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের লড়াই হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায় এমপি সমর্থিত প্রার্থী রয়েছেন। এমপিদের কারণে আওয়ামী লীগের অনেক যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীরা ভোটের মাঠে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। আওয়ামী লীগের দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনা অমান্য করে ভোটের মাঠে রয়েছেন এমপিরা।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাংশা উপজেলা নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী অধ্যাপক ফরিদ হাসান ওদুদ বলেন, পাংশার ১০টি ইউপি রয়েছে। এর মধ্যে রেলমন্ত্রী জিল্লুর হাকিমের নিয়ন্ত্রণে ছিল আট জন চেয়ারম্যান। এই আট জন চেয়ারম্যানের মধ্যে চারটি ইউপিতে ব্যালটে ব্যাপক সিল মেরে আমাকে পরাজিত করা হয়। মূলত ইউপি চেয়ারম্যানদের সঙ্গে নিয়েই তাকে জোরপূর্বক পরাজিত করা হয়।

আগামী ২১ মে অনুষ্ঠেয় দ্বিতীয় ধাপের ভোটে লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় প্রার্থী হয়েছেন অধ্যক্ষ মামুনুর রশিদ। তিনি স্থানীয় এমপি অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়নের বোনজামাই। এ উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের প্রায় সব কটির চেয়ারম্যানকে নিজের বোনজামাইয়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ করেছেন এমপি। এর মধ্যে রয়েছেন ১ নম্বর উত্তর চর আবাবিল ইউপি চেয়ারম্যান জাফর উল্লাহ দুলাল হাওলাদার, ৩ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান শফিক পাঠান, ৪ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান কিসমত উকিল, ৫ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান সুলতান মামুনুর রশিদ, ৬ নম্বর কেরোয়া ইউপি চেয়ারম্যান শানুরি আক্তার রেখাসহ ৯ জন। শুধু ২ নম্বর চর বংশী ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হোসেন মাস্টার ও ৮ নম্বর ইউপি চেয়ারম্যান মিন্টু ফরায়েজী অন্য প্রার্থী আলতাফ হোসেন মাস্টারের হয়ে কাজ করছেন। শুধু লক্ষ্মীপুরের রায়পুর নয়, দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিতব্য প্রায় শতাধিক ইউপিতে প্রকাশ্য এমপিরা প্রভাব বিস্তার করছেন। ভোটের মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য ইউপি চেয়ারম্যানদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। তৃতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে প্রার্থী হয়েছেন কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহিদের আপন ছোট ভাই ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল। আগামী ২৯ মে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে এ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের সব কয়জন চেয়ারম্যানই কৃষিমন্ত্রীর ভাইয়ের পক্ষে এককাট্টা হয়ে মাঠে নেমেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, স্থানীয় এমপির বাইরে গিয়ে অন্য প্রার্থীর পক্ষে কাজ করলে তাদের কপাল পুড়বে। তাছাড়া এমপিরা অনেক প্রভাবশালী। নানা কারণে ইউনিয়ন পরিচালনার জন্য এমপির প্রয়োজন হয়। আগামী নির্বাচনে কে কোন ইউপি থেকে চেয়ারম্যান হবেন সেটিও নির্ধারণ করে দেন এমপি। অতএব এমপিরা যে নির্দেশনা দেন তারা সেটি বাস্তবায়ন করে থাকেন।

এ ব্যাপারে জানতে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনি বিধি অনুযায়ী উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনি প্রচারণা ও হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তারা সেটির কোনো তোয়াক্কা করছেন না। নির্বাচন কমিশন সব কিছু জানলেও তারা কঠিন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, উপজেলা ভোটে ইউপি চেয়ারম্যানদের জন্য কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে মন্ত্রী-এমপিরা প্রভাব বিস্তার করলে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।