এক বদলিতে পাল্টে গেছে শিক্ষা ক্যাডার নির্বাচনের চিত্র
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
সাজ্জাদ হোসেন:
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে রোববার (৯ জুন)। নির্বাচনের তিনদিন আগে ‘গ’ প্যানেলের একজন সভাপতি প্রার্থীকে শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নজিরবিহীন বদলির এ ঘটনায় পাল্টে গেছে নির্বাচনের চিত্র।
এই বদলির প্রভাবে ভোটাররা নানা হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষা প্রশাসন ও বিভিন্ন সরকারি কলেজে কর্মরত শিক্ষকরা।
এবারের নির্বাচনে তিনটি প্যানেল ও দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে একটি প্যানেলের নেতৃত্বে রয়েছেন রুহুল কাদির-হুমায়রা-কামাল। আরেকটি প্যানেলের নেতৃত্বে রয়েছেন মামুন-জিয়া-নাসির। আর তৃতীয় আরেকটি প্যানেল হচ্ছে শাহেদ-তানভীর-মোস্তাফিজ। তিনটি প্যানেল অংশ নিলেও মূল লড়াই হবে শাহেদ-তানভীর প্যানেল
বনাম মামুন জিয়া প্যানেলের মধ্যে।
সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সাবেক দুই বারের মহাসচিব শাহেদুল খবির চৌধুরী শক্ত প্রার্থী হওয়ায় তাকে নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) পদে কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানে বসে নির্বাচন ও ভোটারদের মাঝে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছেন এমন অভিযোগ ওঠে। অন্য প্যানেলের প্রার্থীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (৬ জুন) তাকে প্রশাসন থেকে রাজধানী বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি করা হয়।
২০১০ সাল থেকে শাহেদুল খবির ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন। সবাইকে তিনি বোঝাতেন, তার ক্ষমতা ও দাপটের কথা। তার সমর্থন ছাড়া ভালো পোস্টিং (পদায়ন) পাওয়া যাবে না, নির্বাচনের আগে এমন একটি বার্তা দিতে থাকেন ভোটারদের। এরপর তাকে প্রশাসন থেকে কলেজে বদলি করা হয়। তার এক বদলিতে ভোটারদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। সুর বদলাতে শুরু করেছেন মফস্বলে থাকা সরকারি কলেজের শিক্ষক এবং দীর্ঘদিন ভালো পদায়ন না পাওয়া শিক্ষা ক্যাডারের অন্যান্য কর্মকর্তারা।
শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষকরা জানান, তার (শাহেদুল খবির) বদলির ফলে অনেকেই ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছেন। কারণ তিনি প্রশাসনে থাকলে দাবি-দাওয়া নিয়ে যেভাবে কথা বলতে পারতেন এখন আর সেভাবে পারবেন না। এছাড়া বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে তার সখ্যতা আগের মতো নেই। এর মূল কারণ সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির ঘনিষ্ঠ লোক হওয়ায় তাকে শুরু থেকেই এড়িয়ে যাচ্ছেন বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী। সর্বশেষ শিক্ষা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে শক্ত প্রার্থী হওয়ার পরও শাহেদের জন্য সুপারিশ করেননি মন্ত্রী। ফলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান বর্তমান মহাপরিচালক প্রফেসর নেহাল আহমেদ। শুধু মন্ত্রী, সচিব নয়, শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি এবং সমিতির সাবেক সভাপতি ও মহাসচিবরা তার (শাহেদুল খবির) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। ফলে অনেকটা একঘোরে হয়ে নির্বাচন করতে হচ্ছে তাকে।
ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রায় এক দশক ধরে সমিতির নেতৃত্বে দিয়েছেন শাহেদুল খবির। দুইবার মহাসচিব ও একবার সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি সবার নেতা হয়ে উঠতে পারেননি। তার বলয়ের বাইরে কাউকে তিনি কোনো সুযোগ দিতেন না। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আলোচিত এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈর সময় দুর্নীতিবাজ ও সমালোচিত কর্মকর্তাদের তিনি আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন। বর্তমানে যে প্যানেল নিয়ে নির্বাচন করছেন তাদের বেশিরভাগই ওই সময়ের সমালোচিত কর্মকর্তা।
তবে মাউশির শাহেদপন্থি কর্মকর্তারা জানান, এবার মাউশির মহাপরিচালক পদের প্রার্থী হিসেবে শাহেদুল খবির চৌধুরীর নাম বেশি আলোচিত হওয়ায় তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা ক্যাডারের দাবি-দাওয়া আদায়ে তার আপসহীন অবস্থান অনেকে ভালোভাবে নেননি। শিক্ষা প্রশাসনে নানা অনিয়ম নিয়েও তিনি সোচ্চার ছিলেন। এসব কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে।
অন্যদিকে সমিতির বর্তমান সহ-সভাপতি ও কারিগরি শিক্ষাবোর্ডে সদ্য পদায়ন পাওয়া চেয়ারম্যান অধ্যাপক অধ্যাপক মামুন উল হকের ‘খ’ প্যানেল রয়েছে শক্ত অবস্থানে। এ প্যানেলের বেশিরভাগ প্রার্থী নতুন মুখ হওয়ায় তাদের প্রতি আগ্রহ বেশি ভোটারদের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি, গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, বোর্ড চেয়ারম্যান এবং সমিতির সাবেক নেতাদের কেউ কেউ এই প্যানেলের হয়ে কাজ করছেন। সভাপতি পদে মামুন উল হকের সাথে শাহেদুলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে।
মামুন উল হকও গত কমিটির নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন। সভাপতির সঙ্গে নানা বিষয়ে মতানৈক্য হওয়ায় গত সমিতিতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি তিনি। তবে এবারের নির্বাচনে প্রচারণায় নানান প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এক সময়ে নায়েমে চাকরি করার সুবাদে তার পরিচিতিও রয়েছে বেশ।
বিভিন্ন ব্যাচভিত্তিক সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারুণ্যের ভোটারদের ঝোঁক মামুন উল হকের প্রতি থাকবে। নির্বাচনে আগে এসব বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে সভাপতি প্রার্থী মামুন উল হক বলেন, ক্যাডারের বিদ্যমান যেসব বৈষম্য রয়েছে সেগুলো নিরসন করতে ব্যর্থ হয়েছেন বর্তমান সভাপতি। সেসব দাবি আদায় করাই হবে আমার মূল টার্গেট। সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছি।
এদিকে বদলির বিষয়ে সভাপতি প্রার্থী শাহেদুল খবির বলেন, নির্বাচনের তিনদিন আগে বদলি করা মানেই বোঝা যাচ্ছে আমাকে হারানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এসব বিষয় আমি চিন্তিত নই, এখন শুধু নির্বাচনের দিকে মনোনিবেশ করতে চাই।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নির্বাচনে ৯৫ পদে মোট ২৩২ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সারা দেশে ২১৪ কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। মোট ভোটার ১৩ হাজার ৫৯৬ জন। সারা দেশের ১১টি সাংগঠনিক শিক্ষা বিভাগে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ সরকারি কলেজ শিক্ষক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ (টিটি কলেজ), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কর্মরত ক্যাডার কর্মকর্তারা এ নির্বাচনে ভোট দেবেন।
ক্যাডার বৈষম্য নিরসনকে প্রাধান্য দিতে চান শাহেদ পরিষদ
নির্বাচনকে ঘিরে ইশতেহার ঘোষণা করেছেন শাহেদ-তানভীর-মোস্তাফিজ প্যানেল। তাদের ইশতেহারে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে শিক্ষা প্রশাসন ও ক্যাডারে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনকে। এরপর অগ্রাধিকার থাকবে- পদোন্নতির চলমান প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা, অধ্যাপকদের তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করা, গ্রেড বিবেচনায় প্রভাষকদের পদোন্নতি চালু করা।
এ ছাড়া সব অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষকে প্রাধিকারের ভিত্তিতে গাড়ি দেওয়া, অধিদপ্তর দপ্তর ও কলেজগুলোতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেডের পদ সৃষ্টি, সব কলেজে অতিরিক্ত একজন উপাধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি করা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, নায়েম, বিএমটিটিআইর বিতর্কিত নিয়োগ বিধিমালা বাতিল, সরকারি কলেজে ডরমেটরি স্থাপন, মাধ্যমিক ও কলেজের প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন এবং বিসিএস সাধারণ শিক্ষা একাডেমি প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেওয়া ইত্যাদি।