রংপুর প্রতিনিধিঃ
‘এমন জাড়োতে (শীতে) ঘরের বাইরোত ব্যার (বের) হওয়া মুশকিল। গোটাল গাও (পুরো শরীর) মোর জড়োসড়ো নাগচে (লাগছে)। মোর বয়সোত আগোত এমন জাড় দ্যাকো (দেখা) নাই বাহে। এবার জাড়োতে মাইনষের অবস্থা খুব কাহিল। অসুখোতে (রোগে) ছাওয়াপোয়ারাও (শিশুরা) ভালো নাই। আইজ মেলাদিন পর একান কম্বল পানু (পেলাম), এ্যলা আইতোত (রাতে) জাড় কম নাগবে।’
এভাবেই বলছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব বয়সী মর্জিনা বেগম। তিস্তা নদীর ভাঙনে বসতভিটা হারানো এই নারীর বসবাস রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের চর গাবুড়া গ্রামে।
মঙ্গলবার বিকেলে ছাওলা ইউনিয়নের কান্দিনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে চরাঞ্চলের তিন শতাধিক শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হয়। জেএনইউপা’র সহযোগিতায় শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ নেয় স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন।
সেখানে মর্জিনা বেগমের মতো তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ এসেছিলেন। শীত নিবারণে একটি করে কম্বল হাতে পেয়ে চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি দেখা যায় এসব অসহায় দুস্থ মানুষের মধ্যে।
সেখানে কথা হলে চর জুয়ান আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ বছির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ঘরবাড়ি নেই। সরকার আশ্রয়ণের ঘর দিয়েছে। এই শীতে ঘরে থাকতেও খুব কষ্ট হচ্ছে। শীতের কারণে ঠিকমতো কাজকর্ম করতে পারছি না। আজ কম্বল পেয়ে খুব ভালো লাগছে। মোটা কম্বলে একটু হলেও শরীরে ঠান্ডা কম অনুভূত হবে।
উপজেলার চর কান্দিনায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় শীতবস্ত্র বিতরণের এই আয়োজন করে স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশন। চরাঞ্চলের অসহায়, দুস্থ ও দরিদ্র মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণের পাশাপাশি সেখানে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে একটি নাটিকা মঞ্চায়ন করা হয়।
অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন পীরগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু নাসের মো. মাহবুবার রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন। এ ছাড়া স্বপ্ন ছুঁই ইয়ুথ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. মেহেদী হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাজু মিয়া উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শোভন কুমার কুন্ডু বলেন, আমরা সব সময় মানবিক কাজে অংশগ্রহণ করে আসছি। এই ধারাবাহিকতা এবার রংপুরের তিস্তাবেষ্টিত চরাঞ্চলে আমরা শীতবস্ত্র বিতরণ করছি। ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে আমরা মানুষের জন্য কাজ করতে চাই।
উপজেলা চেয়ারম্যান আবু নাসের শাহ মো. মাহবুবার রহমান বলেন, উত্তরাঞ্চলে শীত জেঁকে বসেছে। এ সময় শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ নিঃসন্দেহে অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
সরকারিভাবে কম্বল বিতরণের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই মানবিক কাজে অংশগ্রহণ যেন আরও বেশি হয়, এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন।
এদিকে আজ বুধবার (১৭ জানুয়ারি) রংপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিভাগের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়, ১০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এবার শীতের আগমন বিলম্ব হলেও গত কয়েক দিন ধরে উত্তর জনপদে সূর্যের দেখা মিলছে না। দিন-রাত অবিরাম কুয়াশায় ঢেকে থাকছে পুরো এলাকা। কুয়াশার সঙ্গে মাঝেমধ্যে বইছে শুষ্ক শীতল বাতাস। এমন অবস্থায় খেটে খাওয়া মানুষেরা রোজগারের জন্য ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। এর ওপর শীতজনিত বিভিন্ন রোগও জেঁকে বসেছে শিশু ও বয়স্কদের মাঝে।
এদিকে বুধবার সকাল থেকে রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কনকনে শীত আর হিমেল হাওয়ায় দাপটে মাঠ-ঘাট অনেকটাই ফাঁকা হয়ে পড়েছে। শহরে একটু ভিড় থাকলেও গ্রামের হাট-বাজারে নেই তেমন চাপ। দোকান খোলা থাকলেও মিলছে না ক্রেতার দেখা। ফলে বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মূলধন খরচ করেই সংসার চালাতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে তীব্র শীতে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন।
রংপুর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বুধবার সকাল ৯টায় রংপুরে দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগের দিন মঙ্গলবার ১১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল।
তিনি আরও জানান, বর্তমানে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ চলছে। একই সঙ্গে স্থানভেদে মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা বিরাজমান রয়েছে।
শীতের এমন রুদ্ররূপকে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল বলে অভিহিত করেছেন অনেকে। উত্তরাঞ্চলের পরিবেশবিদ হিসেবে পরিচিত আহসান রহিম মঞ্জিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৌষ বা মাঘ মাস বলে কোনো কথা নয়, জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন। চলতি বছর যে হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল তাতে মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, এবারের শীতে যে হারে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা নেমেছে যা উপভোগের চেয়ে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে বলছে, ২০১৮ সালের ৮ জানুয়ারি উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছিল আবহাওয়া অফিস। যা ছিল দেশের ইতিহাসে সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড। এর আগে সবচেয়ে কম তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি শ্রীমঙ্গলে, আর সেটি ছিল ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ ছাড়া ২০১৩ সালের ১০ জানুয়ারি নীলফামারীর সৈয়দপুরে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি এবং নীলফামারীর ডিমলা ও কুড়িগ্রামের রাজারহাটে ৩ দশমিক ১ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। ওই সময় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা এত নিচে নামলেও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৮ এর ঘরে ছিল। ফলে শীত সেভাবে মনে হয়নি তখন।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যদি ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে আসে, সেখানে শীতের অনুভূতি বাড়তে থাকে। কিন্তু পার্থক্য যদি পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে আসে তবে শীতের অনুভূতি প্রকট থেকে প্রকটতর হয়। অর্থাৎ হাড়কাঁপানো শীত অনুভূত হয়’, যা এখন রংপুর অঞ্চলে টানা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে। ঘন কুয়াশার বিস্তার এবং সূর্যের আলো না পাওয়ার কারণে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার ব্যবধান পাশাপাশি অবস্থান করছে।
এদিকে শীতে অগ্নিদগ্ধ রোগী ছাড়াও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শীতের প্রকোপে ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়াসহ শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তির চাপ বাড়ছে। গত কয়েক দিনের তুলনায় হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতজনিত রোগীও বাড়তে শুরু করেছে। বেশির ভাগ শিশু ও বয়স্করা শীতে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।