ওসির বিরুদ্ধে নিজ থানায় কর্মরত কনস্টেবলকে হত্যার হুমকির অভিযোগ

প্রকাশিত: ৮:৪৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২১

এবার রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) বহুল আলোচিত বোয়ালিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মনের বিরুদ্ধে নিজ থানায় কর্মরত কনস্টেবল মনিরুল ইসলামকে কর্তব্যরত অবস্থায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে কনস্টেবল মনিরুলের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা রিতা গত ২৭ জুন আরএমপি কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।

পুলিশ কমিশনারের দপ্তর অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্তের জন্য আরএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) রশীদুল হাসানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, রাজিয়া সুলতানা রিতার স্বামী কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম ২০১৬ সাল থেকে বোয়ালিয়া মডেল থানায় মুন্সী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। শুরু থেকেই তিনি সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। গত ২৬ জুন বেলা ১১টার দিকে বোয়ালিয়া থানায় কর্মরত কনস্টেবল আফরোজা আক্তার, কনস্টেবল রাজিয়া সুলতানা, কনস্টেবল মোস্তাক আহমেদ্দের উপস্থিতিতে বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মন তার স্বামী মনিরুল ইসলামকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করেন। তার হুমকি ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ এবং ভয়ভীতির কারণে কনস্টেবল মনিরুল শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর ওসির গাড়িতে করে ওইদিন দিবাগত রাত ১০টার দিকে তাকে চিকিৎসার জন্য রাজশাহী পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক তার স্বামীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন ও বাড়িতে তিন দিনের বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। তার স্বামী সুস্থ হতে পারেননি ও প্রাণনাশের হুমকির ভয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এ সংক্রান্তে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। তাই তিনি তার স্বামীকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করার কারণে বোয়ালিয়া থানার ওসির বিরুদ্ধে সুষ্ঠু তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
কনস্টেবল মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি থানায় মুন্সী হিসেবে কর্মরত আছি। মামলা তদন্ত করেন অফিসাররা। কোনো ভুল হলে তারা করেন সেটার দায়ভারতো আমার নয়। কিন্তু ওসি স্যার অকারণে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। মারধর করতেও উঠেন। ২৬ জুনেও আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও প্রাণনাশের হুমকি দেন। আমি অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক ৩ দিনের বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। সুস্থ না হতে পারার কারণে আবার আমাকে ৩ দিনের বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। ওই ঘটনার পর আমি আর সুস্থ হতে পারছিনা। আশঙ্কা কাজ করছে। ওসি সাহেব শুধু আমাকেই নয় থানার অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের সাথেও খারাপ আচরণ করেন ও মারতে উঠেন। এ নিয়ে থানায় অন্যান্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্যারদের কাছে। আমি মুখ বুঝে সহ্য করলেও আমার স্ত্রী আমার শারীরিক অবস্থা দেখে চুপ থাকতে পারেননি তাই অভিযোগ দিয়েছেন।’

এ বিষয়ে অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (সদর) রশীদুল হাসান (পিপিএম) বলেন, ‘বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসির বিরুদ্ধে কনস্টেবল এর স্ত্রীর করা অভিযোগটি তদন্তের জন্য আমার কাছে এসেছে। সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে রিপোর্ট দেওয়া হবে।’

অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বোয়ালিয়া থানার এক পুলিশ সদস্য বলেন, থানায় যোগদান করার পর থেকেই ওসি তার অধীনস্থদের সাথে খারাপ আচরণ শুরু করেন। যাকে তাকে মারতে উঠেন। এনিয়ে প্রচুর ক্ষোভ রয়েছে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেন না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের খতিয়ে দেখা উচিত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু পুলিশ কনস্টেবল এর স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা রিক্তাই নয়, বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মনের বিরুদ্ধে সাংবাদিক ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ একাধিক মানুষের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলোর তদন্ত হলেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওসি নিবারণ।

রাজশাহীর সিনিয়র সাংবাদিক সুজাউদ্দিন ছোটন ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসির বিরুদ্ধে পুলিশ কমিশনারের কাছে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করেন। অভিযোগটি তদন্ত করেন আরএমপির শাহ্ মখদুম জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তদন্ত রিপোর্ট শক্তভাবে দেওয়া হলেও এখনো সাংবাদিক ছোটন তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার ন্যায্য বিচার পাননি বলে জানান।

সাংবাদিক সুজাউদ্দিন ছোটন বলেন, ‘বোয়ালিয়া থানার ওসি আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এরপর আমি পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। তদন্ত রিপোর্ট শক্তভাবে দেওয়ার পরও এখনো পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আছেন ওসি। আমি ন্যায্য বিচার পাইনি। এভাবে প্রশাসন চলতে পারেনা। আমি আবারো ন্যায্য বিচার দাবি করছি।’

গত মার্চে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি সারদায় কর্মরত এক নারী পুলিশ পরিদর্শক হোসনে আরা পুতুল বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসির বিরুদ্ধে তাকে কুপ্রস্তাব দেয়ার এবং তাতে রাজি না হওয়ায় স্বামীকে তুলে এনে মারধর ও মিথ্যা মামলা দেয়ার বিষয়ে আরএমপির কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। সেই অভিযোগের এখনো কোনো কুল কিনারা হয়নি বলে তিনি জানেন। তার প্রতি প্রতিহিংসার কারণেই তার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করার অভিযোগ তোলেন ওসির বিরুদ্ধে ওই নারী পুলিশ কর্মকর্তা।

পুলিশ পরিদর্শক হোসনে আরা পুতুল বলেন, ‘আমার স্বামীকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ তুলে পুলিশ কমিশনার স্যারের কাছে অভিযোগ করেছি। এখনো অভিযোগের কোনো অগ্রগতি হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও আমাকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। লকডাউনের কারণে ঢাকায় যেতে পারছিনা। লকডাউন শেষ হলে ঢাকায় গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করে অভিযোগ দিব ও আইজিপি স্যারের সাথে সরাসরি দেখা করে অভিযোগ দিবো। রাজশাহীতে আমি ন্যায্য বিচার পাবোনা বলে আশঙ্কা করছি।’

নগরীর শিরোইল মঠপুকুর এলাকার মৃত ইব্রাহিম দেওয়ানের মেয়ে তাজনুভা তাজরিন বোয়ালিয়ার ওসির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। সেটারো কোনো কুল কিনারা হয়নি। তাজনুভা তাজরিন বলেন, আমি এ পর্যন্ত পুলিশ কমিশনার স্যার এর কাছে ৩টি অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনোটার সুরাহা হয়নি। লকডাউনের কারণে ঢাকা যেতে পারছিনা। লকডাউন শেষ হলে ঢাকায় গিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে ন্যায্য বিচার চাইবো। এছাড়াও আরেক নারী সম্প্রতি ওসির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এভাবে একের পর এক অভিযোগ ও বিভাগীয় মামলা থাকার পরেও কিভাবে তিনি বহাল?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরএমপির আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ কমিশনার স্যারের অধীনে সমস্ত কর্মকর্তা। আমরা কেউ পরিদর্শক পদমর্যদার কারো বদলি বা ব্যবস্থা নেওয়ার কর্তৃপক্ষ নই। কিভাবে এখনো তিনি আছেন তা আমাদের জানা নেই।’

এ বিষয়ে বোয়ালিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মন বলেন, ‘২৬ জুন এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তার সাথে আমার দেখাও হয়নি। সে পান খায়। অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আমিই নিজের গাড়িতে করে পুলিশ হাসপাতালে পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে করা তার স্ত্রীর অভিযোগ সত্য নয়। কনস্টেবল মনিরুল কাজে প্রায়ই ভুল করে। সে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে অন্যজনকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাকে গালিগালাজ করা হয়নি।’
সূত্র- ইত্তেফাক।