কলঙ্কমুক্তির সংস্কার, প্রভাবমুক্ত দায়িত্ব পালনের সুযোগ চায় পুলিশ

প্রকাশিত: ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

‘কলঙ্কমুক্তির জন্য’ পুলিশ বাহিনীতে আমূল সংস্কার ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কর্মের পরিবেশ নিশ্চিতকরণের দাবি জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

সোমবার (১৭ মার্চ) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা এ দাবি উত্থাপন করেছেন।

স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বাধীন পুলিশ কমিশনের বিষয়টিও পুনর্ব্যক্ত করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বাধীন ও স্বশাসিত কমিশন গঠন করা সম্ভব না হলে পুলিশ তার পুরোনো নেতিবাচক চরিত্রে ফিরে যাবে– এমন আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা।

বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বড় ঘটনাগুলোয় ঘটনাস্থলে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন যানবাহন নেই। অপারেশনাল কাজে জরুরি ভিত্তিতে যানবাহন প্রয়োজন।

এতে পুলিশের পরিবহন সংকটসহ লজিস্টিক সুবিধার ঘাটতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের কোনো ‘রাজনৈতিক পক্ষপাত’ এর সঙ্গে জড়িত না হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব এবং আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া দেন প্রধান উপদেষ্টা।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আহসান হাবিব ও রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) ফারজানা ইসলাম।

বাহিনীকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করা হয়েছে

বৈঠকে ডিআইজি আহসান হাবিব বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর বিপর্যস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ পুলিশ। জন আস্থাহারা ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে মনোবল হারিয়েছিল পুলিশ। ৫ ও ৬ আগস্টের পর এই বাহিনীর কিছু বিপথগামী পুলিশ সদস্যের দ্বারা বাহিনীকে ধ্বংসের সর্বশেষ চেষ্টা করা হয়েছিল। পরাজিত সেই শক্তির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তা আমরা নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি বলেন, এই অপচেষ্টার পর অরক্ষিত হয়ে পড়েছিল রাজারবাগ পুলিশ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জনগণের নিরাপত্তা দিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে আমাদের পুলিশ সদস্যরা। জনসম্মুখে নিজের পরিচয় দিতেও আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। পুলিশ বাহিনীর সবচেয়ে বড় ক্রাইসিস ছিল ৫-৬ আগস্টের পরবর্তী সময়টায়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল কুমিল্লা পুলিশ লাইনস, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানা, লোহাগড়া থানা, পাহাড়তলি থানা। বিভিন্ন থানার যানবাহন ও গুরুত্বপূর্ণ নথি, আলামত, রেজিস্ট্রার্ডসহ যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ চিত্র শুধু চট্টগ্রামে নয়, সমস্ত বাংলাদেশের। লুট করা হয় অস্ত্র গোলাবারুদ। যার সব এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার কার্যক্রম আমরা পরিচালনা করছি। এ বিষয়ে আমরা হয়ত বড় সংবাদ খুব দ্রুতই উপস্থাপন করতে পারব।

এই ডিআইজি বলেন, পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে ধ্বংসলীলার পর দায়িত্ব পালন করা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। আমরা কার্যক্রম চালু রেখেছি। মামলাগুলো বিশেষ করে তদন্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।দায়িত্ব পালনে পুলিশ চায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি

বৈঠকে উপস্থিত একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল থেকে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন না করতে প্রধান উপদেষ্টা কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, ‘বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আমরা বাহিনীতে এমন সংস্কার চাই, যাতে রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াই দায়িত্ব পালন করতে পারি।’

বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বক্তব্য উপস্থাপনকালে চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের ডিআইজি আহসান হাবিব বলেন, সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে পুলিশ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ও সমস্ত ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল জনপ্রত্যাশা পূরণ, মনোবল ফিরিয়ে আনা, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করা, আমরা সেটা পেরেছি। আমরা চাই জনপ্রত্যাশা পূরণে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশে পেশাদারিত্ব ও দক্ষতার স্বার্থে পুলিশ যেন স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে।

সত্যিকারের পরিবর্তনের সংস্কার চায় পুলিশ

তিনি বলেন, আমরা বারবার পুলিশের সংস্কারের কথা বলছি। বহুদিন ধরে আলোচনা চলছে। আমরা পরিবর্তন চাই। কিন্তু কেন যেন বারবার সংস্কারের বিষয়টি ঠেকে যাচ্ছে। যারা সংস্কার চায় না তারা পুলিশ ও দেশের এগিয়ে যাওয়া দেখতে চায় না। এবার যদি এই সুন্দর পরিবেশেও পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার করা না যায় তাহলে আগামীতে আর সম্ভব হবে কি না জানি না।

কলঙ্কমুক্তির জন্য ম্যানেজ করার সংস্কৃতি ভাঙতে হবে

বৈঠক ডিআইজি আহসান হাবিব বলেন, বিগত দিনগুলোতে পুলিশকে ম্যানেজ করার সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। আমাদের ম্যানেজ করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখানেই পুলিশ কলঙ্কমুক্ত হবে। এই ব্যালান্স বা ম্যানেজ সংস্কৃতির কারণে পুলিশ কলঙ্কমুক্ত হতে পারে না। সেজন্য পুলিশের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট দিয়ে বিনিয়োগ হিসেবে দেখলে দেশ ও জাতির কল্যাণ ও উপকার হবে।

তিনি বলেন, পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় অল্প সংখ্যক পরিবহন এবং অপারেশনাল যানবাহন রয়েছে, যার কারণে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনার জন্য অভিযান পরিচালনা করতে আমাদের প্রায়শই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যে পরিমাণ পেট্রোল টিম থাকা দরকার তা নেই। সেজন্য যানবাহন বাড়ানোর কথা বলা হয়। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকায় কর্মরত কর্মকর্তাদের জন্য টিএ-ডিএ ভাতা বৃদ্ধিরও অনুরোধ জানানো হয়।

প্রধান উপদেষ্টার নিজ থানা পুলিশের বেহাল দশা তুলে ধরা হয় বৈঠকে

চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার বাসিন্দা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে সেই থানার উদাহরণ তুলে ধরে বলা হয়, হাটহাজারী থানার অধীনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। এ থানা এলাকার আয়তন ২৪৬ বর্গকিলোমিটার। বাসিন্দা চার লাখ ৩০ হাজার। এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার জন্য রয়েছে আধা সচল গাড়ি। চারটি মোটরসাইকেল ছিল তাও পুড়ে গেছে। জনবল ১০৭ জন। প্রতি চার হাজারে মাত্র একজন পুলিশ। এই সামান্য জনবল-যানবাহন নিয়ে জনগণের সেবা দেওয়া কতটা সম্ভব তা প্রধান উপদেষ্টাকে অনুভব করার অনুরোধ জানানো হয়।

বৈঠকে তুলে ধরা হয়, পুলিশ কর্মকর্তারা সাধারণ ডায়েরির তদন্ত পরিচালনার জন্য যথাযথ ভাতা বা ব্যয় পান না, যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বৈঠকে বক্তব্য দেওয়া রাজশাহীর এসপি ফারজানা ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসন্ন ও পরবর্তী জাতীয় বাজেটে একটি প্রকল্প রাখার অনুরোধ করেছি যাতে তহবিল উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায়।

তিনি বলেন, কর্মকর্তাদের জন্য আবাসিক সুবিধা এবং ব্যারাকের মান উন্নত করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ করে কনস্টেবল ও নারী সদস্যদের জন্য। ওয়াশরুম সুবিধা, ট্রাফিক পুলিশের জন্য জনবল বৃদ্ধি, পানীয় সুবিধা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। নারী সদস্যদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টারের পদক্ষেপ নেওয়ারও অনুরোধ করা হয়েছে।ফারজানা বলেন, নারী ও শিশু ডেস্কে নারী পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়নের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। দাবিগুলো শোনার পর প্রধান উপদেষ্টা সেগুলো খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষ হওয়ার পর পুলিশ সদর দপ্তরে একটি সভা হয়। সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম পুলিশ কর্মকর্তাদের আইন অনুসারে তাদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন।

তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কিছু চ্যালেঞ্জ আসবে, যা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। পুলিশ প্রধান সব এসপি এবং মহানগরের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। চলমান কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করারও পরামর্শ দেন।

এর আগে বৈঠকে আইজিপি বলেন, যদি কেউ পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে তবে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।

অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়ার খরচা বরাদ্দের দাবি

বৈঠকে উপস্থিত চট্টগ্রামের আরেক পুলিশ সুপার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ পাওয়ার খবরে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। কিন্তু সেই অজ্ঞাত লাশের আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অন্তত ১০ হাজার টাকা খরচা হয়, যা পুলিশ কখনো পায় না।

পুলিশের সক্রিয়তার প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন

গাইবান্ধার নবাগত এসপি নিশাত এ্যঞ্জেলা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ আগের মতো কাজ করে না এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। তবে আমরা কি পরিমাণ কাজ করছি তা উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা বলেছি আমরা কাজ করি বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে।

বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মানের ও জনপ্রত্যাশার আগামী জাতীয় নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গী সারথি হিসেবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।