ডেস্ক রিপোর্ট :
বহুল আলোচিত আবগারি নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির (এএপি) প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়াল। মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তার হওয়ায় দিল্লির প্রশাসন কীভাবে পরিচালিত হবে সেই প্রশ্ন উঠেছে। তবে আম আদমি পার্টি এই বিষয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, কারাগারে থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন কেজরিওয়াল।
শুক্রবার দেশটির সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও কারাগার থেকে সরকার পরিচালনায় আম আদমি নেতাকে ঠেকানোর মতো আইনি বাধা নেই, তারপরও কারাবিধি এটাকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলতে পারে।
দিল্লির তিহার কারাগারের সাবেক একজন আইন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘একজন কারাবন্দি সপ্তাহে দুটি বৈঠক করার অনুমতি পান; যা কেজরিওয়ালকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন কঠিন করে তুলবে।’’
সুনীল গুপ্ত নামে একজন আইনজীবী এনডিটিভিকে বলেন, ‘‘কারাগার থেকে সরকার পরিচালনা করা সোজা নয়। কারাগারের বিধিতে বলা আছে, আপনি পরিবার, বন্ধু-বান্ধব অথবা সহযোগীদের সাথে সপ্তাহে মাত্র দু’বার দেখা করার সুযোগ পাবেন। এসব বিধি-নিষেধের কারণে সরকার পরিচালনা করা তার জন্য সহজ হবে না।’’
তবে ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘কেজরিওয়ালের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের একটি উপায় আছে। যে কোনও একটি ভবনকে কারাগারে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা আছে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের। আর কেজরিওয়াল যদি তাকে গৃহবন্দি করতে রাজি করাতে পারেন, তাহলে সেটিই কেবল তাকে দিল্লি সরকারের দৈনন্দিন কাজের অংশ হতে সহায়তা করবে।’’
অতীতেও আদালত ভবনকে অস্থায়ী কারাগার হিসেবে ব্যবহার করার নজির আছে ভারতে। সেই উদাহরণ টেনে সুনীল গুপ্ত বলেন, ‘‘প্রশাসকের কাছে যেকোন ভবনকে কারাগার হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা আছে। এই ধরনের পদক্ষেপ বন্দিদশায় থেকেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সরকার পরিচালনাকে সহজ করতে পারে।’’
ভূমি কেলেঙ্কারির এক মামলায় গত জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন। ওই সময় রাজ্যের গভর্নরের সাথে সাক্ষাতের পর পদত্যাগ করেন তিনি। পরে দেশটির কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) তাকে গ্রেপ্তার করে। তখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় সরেনের দলের নেতা চাম্পাই সরেনকে।
১৯৯৮ সালে বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদবকে খাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সময় স্ত্রী রাবরি দেবীর কাছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলেন তিনি।
দিল্লির মদ নীতি মামলায় দুর্নীতির অভিযোগে ইডি অন্তত ৯ বার কেজরিওয়ালকে তলব করেছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি ইডির তলব এড়িয়ে গেছেন। দিল্লির হাইকোর্টে কেজরিওয়াল গ্রেপ্তারি এড়ানোর বিষয়ে আবেদন করলেও তা নাকচ করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের পর এএপির নেতা অতীশি বলেন, দলের নেতৃত্বে কোনও পরিবর্তন হবে না। বর্তমানে দিল্লির রাজ্য সরকারে ২ নম্বর অবস্থানে রয়েছেন তিনি।
অতীশি বলেছেন, ‘‘অরবিন্দ কেজরিওয়াল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী আছেন এবং থাকবেন… এটা নিয়ে অন্য কোনও উপায় নেই।’’ কিন্তু দেশটির কিছু সূত্র এনডিটিভিকে বলছে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল পদত্যাগ না করায় সরকার পরিচালনায় কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দেশটির আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত বা অপসারণ করতে পারে। কারণ তিনি একজন সরকারি কর্মচারি। গ্রেপ্তারকৃত সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা হয়। তাদের তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টির সরকার ২০২১ সালে দিল্লিতে নতুন একটি আবগারি নীতি চালু করে। নীতি অনুযায়ী, সরকার মদ বিক্রয় থেকে সরে আসে এবং বেসরকারি লাইসেন্সধারীদের মদের দোকান চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়।
সেই সময় কেজরিওয়ালের সরকার জানায়, মদের কালোবাজারি বন্ধ, সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি এবং সামগ্রিকভাবে গ্রাহকদের সুবিধা দিতেই নতুন আবগারি নীতি করা হয়। এতে বলা হয়, মধ্যরাত পর্যন্ত মদের দোকান খোলা রাখতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি দোকানে বিভিন্ন ধরনের ডিসকাউন্ট দেওয়ার সুযোগও রাখা হয় নীতিতে।
এই নতুন নীতি কার্যকর হওয়ার পরপরই মদের বিক্রি হঠাৎ আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। দিল্লি সরকারের রাজস্ব এক লাফে ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। তবে দেশটির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার নতুন আবগারি নীতির বিরোধিতা করে। বিজেপির অভিযোগ, আবাসিক এলাকায় মদের দোকান খোলার অনুমতি এবং রাজধানীতে ‘‘মদের সংস্কৃতি’’ চালু করছে আম আদমি পার্টির সরকার।
দিল্লির মুখ্যসচিব নরেশ কুমার ২০২২ সালের জুলাইয়ে নতুন আবগারি নীতিতে একটি গুরুতর অনিয়মের বিষয় চিহ্নিত করেন। তার তৈরি তদন্ত প্রতিবেদনে মদের লাইসেন্সধারীদের ‘‘অন্যায্য সুবিধা’’ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালীন মদের লাইসেন্স ফি বাবদ ১৪৪ কোটি টাকা ছাড়ের কথাও তুলে ধরেন ওই কর্মকর্তা।
তার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এই ঘটনায় সিবিআই তদন্তের সুপারিশ করেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা। এরপরই আম আদমি পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর বিজেপি তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ করতে থাকে। দিল্লির ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সব অভিযোগই অস্বীকার করা হয়। তবে বিতর্ক ওঠার পরই নতুন আবগারি নীতি প্রত্যাহার করে নেয় দিল্লি সরকার।
এর ফলে দিল্লিতে নতুন চালু হওয়া ৪০০টিরও বেশি দোকান বন্ধ হয়ে যায়। নতুন নীতি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত মদ বিক্রি আবার সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পরে মামলার কয়েকজন অভিযুক্ত ও সাক্ষীর বক্তব্যে কেজরিওয়ালের নাম উঠে আসে। কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে ইডির চাওয়া রিমান্ড নোট ও চার্জশিটে এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইডি অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে মদ নীতি কেলেঙ্কারি মামলার ‘‘ষড়যন্ত্রকারী’’ বলে অভিহিত করেছে। ইডি বলেছে, মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও আম আদমি পার্টির নেতা মণীশ শিশোদিয়া এবং সঞ্জয় সিং মদ নীতি তৈরিতে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) নেতা কে. কবিতা।
কথিত ষড়যন্ত্র অনুযায়ী, দিল্লিতে এমন এক মদ নীতি তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়; যা দক্ষিণ ভারতের একটি মদের লবিকে সুবিধা দেবে। ইডির তথ্য অনুযায়ী, এর বিনিময়ে সেই ‘‘দক্ষিণ লবি’’ আম আদমি পার্টিকে ১০০ কোটি রুপি দেবে।
দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি বলেছে, মদ নীতি মামলার অন্যতম অভিযুক্ত বিজয় নায়ার প্রায়ই কেজরিওয়ালের অফিসে যেতেন এবং বেশিরভাগ সময় সেখানেই কাটাতেন। নায়ার মদ ব্যবসায়ীদের বলতেন যে, তিনি কেজরিওয়ালের সাথে মদ নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, নায়ারই কেজরিওয়ালের সাথে মদ কোম্পানি ইন্দোস্পিরিটের মালিক সমীর মাহেন্দ্রুর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
সেই সাক্ষাতে আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় পরবর্তীতে কেজরিওয়ালের সাথে মাহেন্দ্রুর ভিডিও কলে কথা বলার ব্যবস্থা করেন। ভিডিও কলে কেজরিওয়াল মাহেন্দ্রুকে বলেছিলেন, নায়ার তার ‘‘সন্তান’’, যাকে তিনি বিশ্বাস করেন।
‘‘দক্ষিণ লবির’’ প্রথম অভিযুক্ত এবং বর্তমানে এই মামলার সাক্ষী রাঘব মাগুন্তা বলেছিলেন, তার বাবা ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টির সাংসদ। তিনিও মদ নীতি সম্পর্কে আরও জানতে কেজরিওয়ালের সাথে দেখা করেছিলেন।
সূত্র: এনডিটিভি।