জেলা প্রতিনিধি, গাজীপুর
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে পাওয়া গেছে সুলতানি আমলের নিদর্শন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ির পাশে সন্ধান পাওয়া এই নিদর্শনটির নাম একডালা দুর্গ।
গত এক মাসের খনন কাজে অনুসন্ধান দল সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে দ্বাদশ শতাব্দীকালে এই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। কথিত আছে দিল্লির সুলতানের আক্রমণের হাত থেকে বাংলার সুলতান এসব দুর্গের মাধ্যমে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।
গত ২৬ ডিসেম্বর কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে রানির ভিটা হিসেবে পরিচিত একডালা দুর্গে খনন কাজ শুরু করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ঐতিহ্য অন্বেষণ নামের প্রত্নতাত্বিক গবেষণা কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক।
খনন শুরুর প্রায় এক মাসের মাথায় সেখানে একডালা দুর্গের ইতিহাস উন্মোচন হতে থাকে। ওই স্থানে ইট, মৃৎপাত্র, নলযুক্ত বিশেষ মৃৎপাত্র, সাধারণ মৃৎপাত্রসহ বিভিন্ন বস্তু পাওয়া গেছে।
খনন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দরদরিয়া গ্রামের একটি নির্দিষ্ট স্থানে ৭টি খাদে খনন করে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্বিক বস্তু ও তথ্য উপাত্ত আবিষ্কার করা হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় দুর্গের আকার, পরিমাপ ও কিছু বস্তু আবিষ্কৃত হয়। দুর্গের আকার অর্ধচন্দ্রাকৃতির। সেখানে আছে দুর্গ-প্রাচীর ও পরিকল্পিত পরিখা। দুর্গের পূর্ব দিকে অর্ধচন্দ্রের পরিধিব্যাপী পরিখা এবং পশ্চিম দিক ঘেষে আছে বানার নদ। আবিষ্কৃত দেয়ালের একটি অংশে দুর্গ প্রাচীরের বুরুজ পাওয়া গেছে। দুর্গ প্রাচীরের সঙ্গে সংযুক্ত বুরুজটি অর্ধবৃত্তাকার। দুর্গের অভ্যন্তর থেকে বুরুজের চিহ্নও পাওয়া গেছে। বুরুজ অংশে একটি মাটির বল আবিষ্কার হয়েছে। এটি প্রাচীনকালে ঐতিহ্যবাহী পোড়ামাটির গোলকের ব্যবহার স্মরণ করিয়ে দেয়। এ ধরনের বস্তু উয়ারী-বটেশ্বরেও পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়।
বুরুজের অপর প্রান্ত (উত্তর পাশে) লাগোয়া কোনো দেয়ালের অংশ নেই। বরং সেখানে চুন-সুরকির ঢালাইয়ের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, দুর্গ-প্রাচীরের পূর্বদিকে একটি প্রবেশদ্বার বা তোরণ ছিল।
এ দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য। খনন সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দরদরিয়া দুর্গটি প্রকৃতি এবং মানব সৃষ্ট পরিখার এক দারুণ কৌশলগত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অর্ধচন্দ্রাকৃতির দুর্গের পরিধি অংশের দুর্গ-প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ৫৫০ মিটার এবং নদীর দিকে সরলরেখায় দুর্গ-প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ৩৩০ মিটার। দুর্গের অভ্যন্তরে প্রত্নতাত্বিক খননে এ পর্যন্ত মানববসতির চিহ্ন বা আলামত পাওয়া গেছে সমতল ভূমি থেকে ২ মিটার নিচ পর্যন্ত। সেখানে পাওয়া বুরুজটি ভিত্তি থেকে ৮৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত ইটের গাঁথুনী টিকে আছে। সামরিক দিক বিবেচনায় বুরুজটি খুবই কৌশলগত স্থাপনা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দুর্গ-প্রাচীরটি দুই দফায় নির্মাণ করা হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। প্রথম নির্মাণ পর্বে ভিত্তিসহ নিয়মিত ইটের গাঁথুনির দেয়াল ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। ইটের টুকরা এবং মাটি মিশ্রিত পদার্থ দিয়ে নির্মিত দেয়াল পাওয়া গেছে ১৪৫ সেন্টিমিটার। তবে দুর্গ প্রাচীরের ওপরের অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে।
দুর্গের ইটের গাঁথুনি থেকে প্রাচীন স্থাপত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে বলে জানান খননের সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্র। তারা জানান, ইটের দেয়াল তৈরির গাঁথুনীতে মর্টার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাটি। মর্টার হিসেবে মাটির ব্যবহার বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্যের একটি ঐতিহ্য।
প্রাথমিক জরিপে দুর্গের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। দুর্গের বাইরের প্রাচীরটি প্রায় অর্ধচন্দ্রাকৃতির। এটি দ্বিস্তর বিশিষ্ট। এই দুর্গ-প্রাচীরের পরিমাপ প্রায় ২ কিলোমিটার। নদীতে মিলিত দুর্গ-প্রাচীরের দুই প্রান্তের দূরত্ব সরলরেখায় প্রায় ১৪০০ মিটার। প্রায় ২ কিলোমিটার বহিঃস্থ দুর্গ-প্রাচীরটির কোনো কোনো জায়গা প্রায় ৪০ মিটার প্রশস্ত এবং প্রায় ৫ মিটার উঁচু। দুর্গ-প্রাচীরের বাইরের দিকে ভূমির গঠন বাইদ ও চালা প্রকৃতির এবং আছে বিস্তৃত গজারী বন জঙ্গল। এই বন-জঙ্গল পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে বর্তমানেও প্রায় ১৫ কিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত। ভূমির গঠন বাইদ ও চালা প্রকৃতি এবং বিস্তৃত বন-জঙ্গল প্রাচীন কালের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ বলে মনে হয়।
দুর্গটির বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেন, আমাদের কাপাসিয়া একটি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলো। আমরা স্বপ্ন স্পর্শ করলাম। এটা বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি পাবে। প্রত্নতত্ব থেকে মানুষের জ্ঞান অর্জন হয়। এটি দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রত্নতত্ব আবিষ্কার।
ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটি পরিকল্পিত একটি দুর্গ। এর একদিকে নদী অন্যদিকে বন। একডালা দুর্গ ইতিহাসের অংশ। যেখানে দিল্লির সুলতানের আক্রমণ থেকে বাংলার সুলতান রক্ষা পেয়েছিলেন।
একই সংগঠনের সভাপতি নুহ উল আলম বলেন, শতবর্ষ আগে থেকেই দুর্গের কোনো কোনো অংশ উন্মক্ত ছিল। সবাই এটিকে রানীর বাড়ি মনে করতেন। তাই এ জায়গাটি পরিচিত ছিল রানীর বাড়ি হিসেবেই। কিন্তু এটা নিয়ে কোনো প্রত্নত্বাতিক গবেষণা হয়নি এতোদিন। এক মাসের অনুসন্ধানে তারা এখন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন দ্বাদশ শতাব্দিতে দুর্গটি নির্মিত হয়েছে। যা ছিল সুলতানী আমলে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসে একডালা দুর্গের অবস্থান নির্ণয় একটি অমীমাংসিত বিষয়। মধ্যযুগে একডালা দুর্গের অস্তিত্ব ছিল। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দিন বারাণীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে একডালা দুর্গের উল্লেখ রয়েছে।