ডেস্ক রিপোর্ট :
কিছুতেই কমছে না শীতের তীব্রতা, বরং প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। আজ সোমবারও (২২ জানুয়ারি) সকাল পর্যন্ত ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো ছিল রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ অঞ্চল। নৌপথে কুয়াশার মাত্রা আরও বেশি। ঘন কুয়াশায় আজও ঢাকা ছিল দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের নৌ-রুটগুলো। সন্ধ্যা নামতেই কুয়াশা আচ্ছন্ন করতে থাকে নৌপথ, যার রেশ ভোরে সূর্যোদয়ের পরেও কাটতে চায় না। কোথাও তো আবার অনেক বেলা গড়ালেও সূর্যের দেখা মিলছে না। রবিবার (২১ জানুয়ারি) রাতেও কুয়াশার চাদরে ঢেকে ছিল রাজধানীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ছিল। সকাল ৭টার দিকেও কমেনি কুয়াশার তীব্রতা।
গত এক মাসের শীতের প্রকোপ আর ঘন কুয়াশার প্রভাবে কমে গেছে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চের সংখ্যা। যেই নৌপথে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত সেখানে এখন যাত্রী ভাটা পড়েছে। যার মূল কারণ কুয়াশা। ঘন কুয়াশার কারণে নৌপথে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনাও। সবমিলিয়ে আতঙ্কে ভুগছেন খোদ লঞ্চ স্টাফরা। অন্যদিকে দুর্ঘটনা এড়াতে নৌপথ বিমুখ হচ্ছেন যাত্রীরা। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে লঞ্চ ছেড়ে গেলেও ঘন কুয়াশার কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা বিলম্ব হচ্ছে। সময় বাঁচাতে ও দুর্ঘটনা এড়াতে অনেকেই নৌপথ এড়িয়ে চলছেন।
লঞ্চ মাস্টারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাত্রাপথে ঘন কুয়াশার কারণে বাল্কহেড ও ছোট নৌযানগুলো দেখতে না পারায় প্রতিনিয়ত নানাধরনের দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। তাছাড়া ঠিকমতো প্রশিক্ষণ না থাকায় বাল্কহেড চালকরা রাতে সঠিকভাবে ড্রাইভিংও করতে পারেন না। এ কারণে লঞ্চ চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে। ঘন কুয়াশায় মাঝ নদীতে লঞ্চ আটকা এবং ধীরগতিতে চলাচল করায় গন্তব্যে পৌঁছাতে লঞ্চের দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত বেশি সময় লাগছে।
ঘন কুয়াশা আর প্রযুক্তির স্বল্পতার কারণে রাজধানী ঢাকার সাথে সারা দেশের লঞ্চ চলাচল বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সদরঘাট নৌ-থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম। লঞ্চ কর্মকর্তাদের তথ্য অনুসারে, গত দেড় মাসে নৌপথে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা টু বরিশাল ও ঢাকা টু চাঁদপুর রুটে। এইসব দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত অন্তত অর্ধশতাধিক আহত এবং দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত ১১ ডিসেম্বর রাতে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার চর ভৈরবী এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি সুরভী-৮ লঞ্চের সঙ্গে টিপু-১৪ লঞ্চের সংঘর্ষে ১ জন নিহত এবং কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। ওই রাতেই মতলব উত্তর উপজেলার মোহনপুর এলাকায় ঘন কুয়াশায় ঢাকা-বরিশাল নৌপথের এমভি রফরফ-৭ ও পটুয়াখালী থেকে ঢাকাগামী এমভি এআর খান-১ লঞ্চের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে ১৫ জন যাত্রী মারাত্মক আহত হন।
৪ জানুয়ারি মধ্যরাতে ঘন কুয়াশার কারণে চাঁদপুরের মতলব উত্তরের আমিরাবাদ এলাকায় মেঘনা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও কার্গোর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে তলা ফেটে চরে আটকা পড়ে বরিশালগামী এমভি সুন্দরবন-১৬ লঞ্চ। এ ঘটনায় এক নারী নিহত হন। ৫ জানুয়ারি ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে আসা এমভি অ্যাডভেঞ্চার ১ লঞ্চের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলকারী এমভি চন্দ্রদ্বীপের সংঘর্ষ হয়। কীর্তনখোলা নদীতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ সময় চন্দ্রদ্বীপ লঞ্চের ২ যাত্রী আহত হন। এছাড়া ৮ জানুয়ারি, ১৩ জানুয়ারি ও ১৭ জানুয়ারিও নৌপথে দুর্ঘটনা ঘটেছে।
ঘন কুয়াশার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটায় আতঙ্কে থাকতে হয় লঞ্চ স্টাফদের। আতঙ্কিত হওয়ার কারণ হিসেবে অভিযান-৫ লঞ্চের মাস্টার মিন্টু বলেন, ‘নৌপথে চলাচলের বড় বাধা ছোট নৌযান। রাতে ঘন কুয়াশায় বালুবাহী বাল্কহেড, ছোট ছোট কার্গো জাহাজ, ট্রলার ও মাছ ধরার নৌকা দেখতে পাওয়া যায় না। তাই নিয়মিত ছোট খাটো দুর্ঘটনা ঘটছে। আমাদের প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকতে হয়। পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে থাকে। কখন কোন বড় দুর্ঘটনা হয় বলা তো যায় না।’
আতঙ্কে আছেন লঞ্চের কর্মীরাও
মুলাদীগামী অভিযান-৩ লঞ্চের মাস্টার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কুয়াশার কারণে আমাদের লঞ্চ চালানো বেশ কঠিন পড়েছে, নিয়মিত দুর্ঘটনাও ঘটছে। কিছুদিন আগে সুন্দরবন-১২, ১৬ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। অনেক লঞ্চে আধুনিক প্রযুক্তি নেই, তাই তারাও পড়েছে বেশ দুর্ভোগে। তারা অনেকে বিআইডব্লিউটিএ নির্দেশনা অনুযায়ী লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে রেখেছে। আবার অনেকে নির্দেশ অমান্য করেই চালাচ্ছেন। লঞ্চের যে লাইট ঘন কুয়াশায় এর আলো ২০-২৫ মিটার পর্যন্ত পৌঁছাতেও কষ্ট হয়। ফলে সামনে থেকে কী আসছে ঠিকভাবে বলা যায় না। এজন্য আমরা যারা লঞ্চের স্টাফ আছি তারা তো আতঙ্কে থাকি, সঙ্গে যাত্রীরাও থাকে। কুয়াশার কারণে এখন মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা হচ্ছে এজন্য গত দুই সপ্তাহে লঞ্চের যাত্রী অনেক কমেছে।’
লঞ্চ শ্রমিক আবু জাফর বলেন, ‘কুয়াশার কারণে লঞ্চ চলাচলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগছে, তাই যাত্রীরা লঞ্চে যেতে চান না। সদরঘাট থেকে আগে প্রতিদিন দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে যেই হারে লঞ্চ চলাচল করতো জানুয়ারির শুরু দিকে সেই সংখ্যা অনেক কমেছে। তাছাড়া প্রতিনিয়ত পত্রিকা বা টেলিভিশন কুয়াশার কারণে লঞ্চে দুর্ঘটনার কথা শুনে যাত্রীরা আরও বেশি শঙ্কিত, এজন্য এখন নৌপথে যাত্রীর ভাটা পড়েছে। এক লঞ্চে হাতেগোনা ৩০০-৩৫০ যাত্রী হয়। যেখানে আগে অনায়াসে যাত্রীর সংখ্যা হাজার পেরিয়ে যেতো। আগে যাত্রীদের টিকেট দিতে দিতে হাঁপিয়ে যেতাম এখন যাত্রী খুঁজতে খুঁজতে হাঁপিয়ে যাই।’
বরিশাল রুটের লঞ্চ যাত্রী মোহাম্মদ আবির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার কাছে নৌপথ ভ্রমণের সবচেয়ে নিরাপদ ও আরামদায়ক পন্থা মনে হয়। কিন্তু শীতের কারণে সেই চিন্তা ভাবনায় কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এসেছে। শীত আসার পর থেকেই নৌপথে দুর্ঘটনা বেড়েছে। যার মূল কারণ কুয়াশা। এজন্য নৌপথে ভ্রমণ করার আগ্রহ কমেছে। পরিবার বা আত্মীয় স্বজনদের ও কুয়াশার মধ্যে লঞ্চ চলাচল এড়িয়ে চলার কথা বলেছি। তাছাড়া সড়কপথে পদ্মাসেতু দিয়ে বরিশাল আসা যাওয়া করতে এখন বেশি সময় লাগে না। তাই অযথা ঝুঁকি নিয়ে নৌপথে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।’
চাঁদপুরে রুটের যাত্রী ফরিদুন্নাহার বলেন, ‘আমাদের চলাচলের জন্য লঞ্চ সার্ভিস সবচেয়ে সুবিধাজনক। শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম; সবসময় লঞ্চ জার্নি নিরাপদ। তবে এবারের শীতে কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছে। আমি ঢাকায় এসেছিলাম আমার শাশুড়িকে নিয়ে। আসার সময় একটা ছোট নৌকার মতো কিছু একটার জোরে ধাক্কা লাগে। আমরা সবাই অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছি। কুয়াশার কারণে আশেপাশের অবস্থা তেমন ভালো করে দেখা যায় না। এইজন্য এই সমস্যাটা হয়েছিল। আজকে আবার লঞ্চে করেই চাঁদপুর ফিরে যাচ্ছি। তবে আজ শাশুড়ি আর আমার ছোট ছেলেকে বাসে পাঠিয়ে দিয়েছি। আর আমি আর আমার মেয়ে লঞ্চে করে যাচ্ছি। যদিও রিমুর আব্বু নিষেধ করছে লঞ্চে না যেতে তবুও চলে এসেছি, তবে কুয়াশা দেখে এখন একটু ভয় লাগছে। আল্লাহ, আল্লাহ করছি যেন তাড়াতাড়ি রোদ উঠে যায়।’
এদিকে সদরঘাট এলাকায় লঞ্চ যাত্রী কম থাকায় অনিশ্চয়তায় জীবন কাটাচ্ছে অনেক হকার। লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক থাকলে যাত্রীদের আনাগোনা থাকে নিয়মিত। কিন্তু কুয়াশা আর শীতের প্রকোপে যাত্রী কমেছে, কমেছে বেচাকেনাও। সদরঘাটের পানি বিক্রেতা হালিমা বেগম বলেন, ‘সদরঘাটে যাত্রী একেবারেই কম। সারা দিনে কেবল দুই-তিন ডজন পানির বোতল বিক্রি হয়, এর মধ্যে বোঝেন কী লাভ হয়। যা থাকে তা দিয়ে পরিবার চালানো কষ্টকর।’