ট্রাম্পের অভিষেক, মার্কিন নীতি ও বাংলাদেশের অর্থনীতি
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
ডেস্ক রিপোর্ট:
অবশেষে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ডোনাল্ড জে ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই প্রত্যাবর্তন আগামীদিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনের প্রতি বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা হলো গাজায় ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর।
বলা যায়, অনেকটা ট্রাম্পের আগমনকে কেন্দ্র করে এই সহিংসতার একটা লাগাম টেনে ধরার মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের ইচ্ছার প্রতি প্রকারান্তরে সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের একটা মীমাংসা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ট্রাম্পের নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতির মধ্যেও উল্লেখ ছিল। এই লক্ষ্যে খুব দ্রুতই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ট্রাম্পের এক বৈঠক অনুষ্ঠানের বিষয়েও জোর আলোচনা রয়েছে।
দায়িত্ব গ্রহণের আগেরদিন ট্রাম্প ওয়াশিংটনে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া প্রায় একঘণ্টার বক্তব্যে তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার একটি ধারণা দিয়েছেন। তিনি ৪ বছর ধরে বাইডেন প্রশাসনের শাসনকালকে আমেরিকার পতনের পথে যাত্রা উল্লেখ করে এর যবনিকা ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সাথে তার বক্তব্যের একটা বড় অংশ ধরে অভিবাসী বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন। জানান দিয়েছেন উদার বামপন্থা বা মধ্যপন্থা অনুসরণের পরিবর্তে তিনি মার্কিন জাতীয়তাবাদকে তার রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন।
বিষয়টি অনেকে নেতিবাচকভাবে দেখলেও, এর অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে। আগের মেয়াদে তার শাসনকালে দেখা গেছে অতীতের প্রেসিডেন্টদের নীতিগুলোর অনেক পরিবর্তন করে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বহির্বিশ্বে আক্রমণাত্মক অনেক নীতি থেকে সরিয়ে আনেন। আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত মার্কিন সেনাদের ফিরিয়ে আনার তৎপরতা তার সময়েই শুরু হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোই তার আগের মেয়াদে প্রাধান্য পেয়েছিল। এর সূত্র ধরেই চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ ছিল বহুল আলোচিত বিষয়। এবারও তিনি এই নীতি থেকে সরে আসেননি। তারপরও ৪ বছর বিরতি দিয়ে নতুন করে দায়িত্ব গ্রহণ করা ট্রাম্প আগের চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ এবং সামনের দিনগুলোয় তার এই আদর্শিক ধারা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বেশি মনযোগী হবেন এটা প্রত্যাশা করা যেতে পারে।
দায়িত্ব গ্রহণের আগেরদিন ট্রাম্প ওয়াশিংটনে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া প্রায় একঘণ্টার বক্তব্যে তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার একটি ধারণা দিয়েছেন। তিনি ৪ বছর ধরে বাইডেন প্রশাসনের শাসনকালকে আমেরিকার পতনের পথে যাত্রা উল্লেখ করে এর যবনিকা ঘটানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
তাছাড়া এটাও গভীর বিবেচনার দাবি রাখে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এবার এমন এক ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, যা মার্কিন নির্বাচনের ইতিহাসে ১২৮ বছরের মধ্যে আগে কখনো ঘটেনি। সে বিবেচনায় জনগণের দিক থেকে ট্রাম্পের পক্ষে রায়ের মাধ্যমে এটাই জানান দেওয়া হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র আর যুদ্ধ চায় না এবং ট্রাম্প ঘোষিত মধ্যপ্রাচ্য এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে জনগণের দিক থেকে চাপ রয়েছে।
তিনি নিজে দায়িত্ব গ্রহণের আগে থেকেই এটা নিয়ে কাজ শুরু করার ফলেই কিন্তু বর্তমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটেছে। সেক্ষেত্রে তিনি শুরুতেই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পরই তার বিদেশ সফরের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে চীন ও ভারত।
প্রচলিত প্রথার বাইরে গিয়ে এবার তিনি তার এই শপথ গ্রহণে বেশকিছু বিশ্বনেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট। চীন তার এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্টকে পাঠিয়েছে। সম্পর্কের অবনতি পরিহার করে এই দুই দেশ আগামী দিনে কীভাবে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে কাজ করতে পারে, এ নিয়ে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
ট্রাম্প একতরফাভাবে চীনের সাথে সম্পর্কের অবনতির সূচনা করবেন, এটা ভাবার কারণ নেই। আর সেজন্যই তার দায়িত্ব গ্রহণের আগেরদিন চীনের টিকটক বন্ধ করার যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাহী আদেশ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাতিল করা হয়। এক্ষেত্রেও ট্রাম্পের ঘোষণা কাজ করেছে।
তিনি এই আদেশের বিপরীতে গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই টিকটকের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা জানিয়েছিলেন। এটি চীন সরকারের জন্যও একটি বার্তা। এরকম অনেক আন্তর্জাতিক বিষয়াদি রয়েছে, যেখানে ট্রাম্পের নীতির ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিগত দিনগুলোর মার্কিন নীতির পর্যালোচনা করলে বাস্তবিক অর্থে বর্তমান সময়ের চেয়ে খারাপ কিছুর আশঙ্কা কম।
মার্কিন সরকার পরিবর্তনের সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনার একটা সম্পর্ক থেকে যায়। বাংলাদেশের সরকারের সাথে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ধরন কেমন হবে, তার ওপর অনেক দেশের সাথেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এবং কূটনীতি নির্ভর করে।
বিগত সরকারের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনের জেরে আমাদের বৈদেশিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি লক্ষ্য করেছি। এই সময়টাতে সরকারের অতিমাত্রায় ভারতমুখী নীতির চাপে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অবনতি লক্ষণীয় ছিল। তবে সাথে এটাও ধরে নিয়ে আমাদের এই আলোচনা করাটা প্রাসঙ্গিক হবে যে বাংলাদেশের কাছে বিগত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কী প্রত্যাশা ছিল।
মূলত এই টানাপোড়েনের জায়গাটি সৃষ্টি হয়েছিল গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো কেন্দ্র করে। যদিও বিশ্বব্যাপী এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে, কৌশলগত স্বার্থের দিকটি বিবেচনা করলে আমরা বুঝতে সচেষ্ট হবো যে ইতিমধ্যে এশিয়ায় ভারত এবং বাংলাদেশের সাথে দেশটির ব্যাপক অর্থনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ২০ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ১৯৮৯ সালে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরুর পর থেকে অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। সেই সাথে রপ্তানি ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৭ থেকে ২০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে। সেই দিক বিবেচনায় আমদানি এবং রপ্তানির মধ্যকার ভারসাম্য বজায় রাখা, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকে নিরাপদ রাখা ইত্যাকার বিষয়ের সাথে তাদের গণতান্ত্রিক ধারণা সম্পর্কিত।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট বৈদেশিক বিনিয়োগের ২০ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ১৭ থেকে ২০ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে…
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতির মধ্যে বাংলাদেশ বিষয়টি উঠে আসার কারণে এবারের ট্রাম্প প্রশাসনের দিক থেকে বাংলাদেশ নিয়ে কী ধরনের ভূমিকা থাকবে—সে বিষয়টি আমাদের জন্য আগ্রহের বিষয় হয়ে সামনে চলে এসেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু বিষয়টি ট্রাম্প প্রশাসনের আগের মেয়াদেও উঠে এসেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এনিয়ে উদ্বেগ প্রদর্শিত হয়েছিল।
তবে এবার তিনি স্পষ্ট করে এক্ষেত্রে ভারতের সাথে তা নিয়ে একত্রে কাজ করার কথা বলেছেন। সেদিক বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দিতে পারেন।
তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মার্কিন প্রশাসন পরিবর্তন এবং সেই সাথে গণতান্ত্রিক বিষয়টি ট্রাম্পের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকার কারণে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সরকার দেখতে অধিক আগ্রহী থাকবে মার্কিন প্রশাসন।
সাম্প্রতিক সময়গুলোয় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে চীনের আগ্রহ যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সাথে বাংলাদেশের সম্পৃক্তির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিকে গুরুত্ব দেবে ট্রাম্প প্রশাসন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান বা ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কার চাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হবে—সেটা ভাবনার কারণ হবে।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়