জেলা প্রতিনিধি, ভোলা
ভোলার মনপুরায় সাগরে ইলিশ শিকারে গিয়ে আজও ফিরে আসেননি ২০ জেলে। তাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন স্বজনরা। স্বজনদের দাবি, তারা বেঁচে আছেন। ঝড়ের কবলে পড়ে তীব্র স্রোতে পথ ভুলে হয়তো অন্য কোনো দেশে গিয়ে আটকা পড়েছেন। সরকারিভাবে দ্রুত জেলেদের খোঁজ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গত বছর ২২ অক্টোবর ভোলার মনপুরা উপজেলার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়নের আক্তার মাঝির এফডি রিনা-১ নামে ফিশিংবোট নিয়ে ওই ইউয়িনয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাঙ্গীর মাঝির নেতৃত্বে একই ইউনিয়নের মো. আলাউদ্দিন মাঝি, মিলন মাঝি, সিদ্দিক মাঝি, ফিরোজ মাঝি, বাতেন মাঝি, আবুল কামাল মাঝি, ইসমাইল মাঝি, আবুল খায়ের দেওয়ান মাঝি, ইয়াকুব মাঝি, সোহাগ মাঝি, শামীম পাটওয়ারী মাঝি, সোহাগ মাঝি-২, মো. সুমন মাঝি, জয়নাল আবেদীন মাঝি, ইয়াছিন মাঝি, ফরিদ মাঝি, মো. আজাদ মাঝি, মামুন মাঝি ও অলি মাঝিসহ সাগরে ইলিশ শিকার করতে গিয়ে আজও ফিরে আসেননি। তাদের অপেক্ষায় এখন পর্যন্ত পরিবারের চলছে শোকের মাতম। দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির সন্ধান না পেয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন স্বজনরা।
নিখোঁজ জেলে মিলন মাঝির স্ত্রী নাসরিন বেগম জানান, তার দুই মেয়ে, এক ছেলে। বর্তমানে অন্তঃসত্ত্বা তিনি। তার পরিবারের আয়ের একমাত্র ব্যক্তিই ছিলেন তার স্বামী। দীর্ঘদিন ধরে স্বামী নিখোঁজ হওয়ায় অভাবের কারণে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। ছেলে-মেয়েরা প্রতিদিনই জিজ্ঞাসা করে তাদের বাবা কবে আসবে, কিন্তু তাদের কোনো উত্তর দিতে পারেন না তিনি। শুধু নীরবে চোখের জল ফেলেন।
মিলন মাঝির বড় ছেলে মাদরাসা শিক্ষার্থী মুক্তা আক্তার জানান, তার বাবা সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে অনেকদিন ধরে ফিরে আসছে না। তাই মাঝেমধ্যে তার ছোটবোন মিতু ও ছোটভাই নিশাদ বাড়ির পাশের জনতা বাজার মৎস্যঘাটে গিয়ে বসে থাকে। তাদের আশা এই বুঝি তাদের বাবা ফিরে আসবে। কিন্তু সবাই ফিরে এলেও তাদের বাবা ফিরে আসে না।
নিখোঁজ জেলে মো. সোহাগ মাঝির স্ত্রী রুমা বেগম জানান, গত ৩ মাস ধরে স্বামীর ফোনে সারাদিন কল দেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে স্বামী নিখোঁজ হওয়ায় ছোট ছোট সন্তান নিয়ে তিনি বিপাকে রয়েছেন।তিনি আরও জানান, প্রায় ৪ বছর আগে স্থানীয় ফারুক মাস্টারের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা দাম ধরে ২০ শতাংশ জমি কিনলেও এখনও পরিশোধ করতে পারেননি সেই টাকা। স্বামী ফিরে না আসলে হারাতে হবে বসতঘরের ভিটাও।
নিখোঁজ জেলে ফিরোজ মাঝির স্ত্রী মমতাজ বেগম ও অলি মাঝির স্ত্রী নাজমা বেগম জানান, নিখোঁজ জেলেরা তাদের পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ছিলেন। তারা নিখোঁজ থাকায় অনেক কষ্টে তাদের সংসার চলছে।মামুন মাঝির ভাবী জানান, তার দেবর সাগরে যাওয়ার ১৫ দিন আগে নতুন বউ ঘরে এনেছেন। দেবরের ফিরে আসার অপেক্ষায় তার নতুন বউ এখন পথ চেয়ে রয়েছেন।
তারা আরও জানান, ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা ও ঘূর্ণিঝড় হামুনের মধ্যেও ফিশিংবোটের মালিক আক্তার মাঝি জেলেদের চাপ দিয়ে সাগরে পাঠান। তাদের স্বজনরা ওই সময় সাগরে যেতে দিতে চাননি। আক্তার মাঝি তাদের দুর্যোগের মধ্যে জোর করে সাগরে পাঠানোর কারণে স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন। তাই আক্তার মাঝির বিচারের দাবি করেন তারা। এছাড়াও সরকারিভাবে সহযোগিতা চান তারা।
অন্যদিকে স্থানীয় জনতা বাজার মৎস্য ঘাটের জেলে মো. ইউনুস মাঝি ও আব্দুল কাদের মাঝি জানান, তাদের ২০ জন জেলে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ রয়েছে। তারা বেঁচে আছে কিনা জানা নেই তাদের। তবে নিখোঁজ জেলেরা বেঁচে থাকলে ঝড়ের কবলে পড়ে দিক হারিয়ে ভারত, মিয়ানমার বা শ্রিলংকায় গিয়ে আটকে আছেন। তাদের সন্ধানের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগের দাবি করেন তারা।
অভিযুক্ত ফিশিংবোটের মালিক মো. আক্তার মাঝি অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, জাহাঙ্গীর মাঝির নেতেৃত্বে তার ফিশিংবোট নিয়ে ওই জেলেরা তাকে না জানিয়ে সাগরে মাছ শিকার করতে যান। জেলেদের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে তিনি গত বছর নভেম্বর মাসের শুরুতে মনপুরা থানায় তাকে না জানিয়ে ফিশিংবোট নিয়ে সাগরে গেছেন বলে সাধারণ ডায়রি করেন।
মনপুরা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম জানান, নিখোঁজ জেলেদের সন্ধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। দেশের সকল থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। আর জেলেদের চাপ দিয়ে সাগরে পাঠানো হয়েছিল এমন অভিযোগ লিখিতভাবে নিখোঁজ জেলেদের পরিবার থেকে এখনও কেউ করেনি। অভিযোগ পেলে দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কামাল আজাদ জানান, জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সাগরে মাছ শিকার করতে গিয়েছেন বলে প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন। নিখোঁজ জেলেদের পরিবার থেকে আবেদন করলে তাদের সরকারিভাবে সহযোগিতার আশ্বাসও দেন তিনি।