চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক শ্রীকৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) নিয়ে ফেসবুকে অন্যের একটি পোস্ট শেয়ার করেন ব্যবসায়ী ওসমান আলী। এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে নগরীর কোতোয়ালি থানার হাজারী গলির মিয়া শপিং সেন্টারে তাঁর দোকানে হামলা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর গেলে তাদের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের অন্তত ১২ সদস্য আহত হন। তাদের মধ্যে মো. ফয়েজ নামে এসিডদগ্ধ পুলিশ সদস্যকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় রাতেই অভিযান চালিয়ে ৮২ জনকে আটক করে যৌথ বাহিনী। পরে কোতোয়ালি থানায় ৮২ জনের নামে ও অজ্ঞাতপরিচয় অন্তত ৬০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন কোতোয়ালি থানার এসআই মিজানুর রহমান। যাচাই-বাছাই শেষে ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
পুলিশের দাবি, ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি, যৌথ বাহিনীর ওপর হামলা ও এসিড নিক্ষেপে জড়িত ধর্মীয় সংগঠন ইসকন। গ্রেপ্তারদের বেশির ভাগ সংগঠনটির সমর্থক। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে সিএমপি মুখপাত্র উপকমিশনার (অপরাধ) রইছ উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, প্রচার, সেখানকার সম্পৃক্ততা, তদন্ত ও গোয়েন্দা তথ্য বিচার-বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছি ইসকন সমর্থকরা সম্পৃক্ত। ওসমান আলী পুলিশ হেফাজতে আছেন। কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি অভিযোগ দিলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তবে ইসকন এ দাবি অস্বীকার করেছে। ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘হাজারী গলিতে সংঘটিত হামলা-ভাঙচুরসহ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্গে ইসকনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শনাক্তের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি।’
মঙ্গলবার রাতের ঘটনার পর হাজারী গলিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে পরিবার নিয়ে এলাকা ছাড়ছেন। গতকাল বুধবার দিনভর দোকানপাট বন্ধ ছিল। জুয়েলার্সের দোকান সিলগালা করেছে প্রশাসন। হাজারী গলির ব্যবসায়ীরা বলছেন, বহিরাগতরা মঙ্গলবার রাতে ঘটনা ঘটিয়েছে। তারা নিরপরাধ ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের মুক্তি দিয়ে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দাবি করেন।
গতকাল নগরের দামপাড়া ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডে সংবাদ সম্মেলনে যৌথ বাহিনী বলেছে, তাদের ওপর জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড, ইটপাটকেল ও কাচের বোতল নিক্ষেপ করা হয়। এতে পাঁচ সেনাসদস্য ও সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
এ সময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ মঙ্গলবার রাতে হাজারী গলিতে ওসমান আলী ও তাঁর ভাইকে হত্যা এবং দোকান জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য জড়ো হয়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের ছয়টি টহল দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে।
বিশৃঙ্খলাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় জানমাল রক্ষা ও মব জাস্টিস রোধে ওসমান আলী এবং তার ভাইকে উদ্ধার করা হয়। উত্তেজিত জনতাকে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানে আশ্বস্ত করার পরও তারা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। দুর্বৃত্তরা এ সময় যৌথ বাহিনীর ওপর অতর্কিতভাবে জুয়েলারির কাজে ব্যবহৃত এসিড নিক্ষেপ, ইট-পাটকেল ও ভাঙা কাচের বোতল ছোড়ে। এর পর দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করতে যৌথ বাহিনীর ১০টি টহল দল রাত সাড়ে ৯টার দিকে হাজারী গলিতে গেলে আবারও লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতরা যৌথ বাহিনীর ওপর এসিড নিক্ষেপ করে।
কী ঘটেছিল হাজারী গলিতে
হাজারী গলির মিয়া শপিং সেন্টারে দুই থেকে আড়াই হাজারের মতো বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫০ ব্যক্তি জুয়েলারি ব্যবসা করেন। সেখানে জুয়েলারি বাক্স, মালা, মালায় ব্যবহৃত স্টোন ও রুপার ব্যবসা করে ওসমান আলী। নিচতলায় তাঁর দোকানের নাম মোল্লা স্টোর। সম্প্রতি ওসমান আলী ইসকনকে নিয়ে আরেকজনের একটি ফেসবুক পোস্ট তাঁর ওয়ালে শেয়ার করেন। এরই জেরে মঙ্গলবার বিকেলে একদল মানুষ মোল্লা স্টোরের সামনে জড়ো হয়। তারা ওসমান আলী ও তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে তর্কে জড়ান। এক পর্যায়ে দু’জনের ওপর হামলা হয়। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, হামলার এক পর্যায়ে মোল্লা স্টোরের শাটার বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েকজন হামলাকারীদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন।
হাজারী গলিতে গতকাল বুধবার অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে সমকাল। তাদের কেউই ওসমান আলী ফেসবুকে কী শেয়ার করেছেন, তা জানাতে পারেননি।
এ ঘটনার জেরে গতকাল হাজারী গলির পাইকারি ওষুধ ও স্বর্ণালংকারের দোকান বন্ধ রাখা হয়। এর মধ্যে জুয়েলার্সের দোকানগুলো সিলগালা। কয়েকটি পরিবারকে এলাকাও ছাড়তে দেখা যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, মঙ্গলবার রাত আতঙ্কে কাটিয়েছি। পরিবার নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছি।
নারায়ণ ধর বলেন, ‘ঘটনার শুরুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বোঝানোর চেষ্টা করে। তাদের ওপর ইটপাটকেল ও এসিড নিক্ষেপ করা হলে, তারা সবাইকে ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে ১৫ মিনিট সময় দেয়। নির্ধারিত সময় পরে যাদের পেয়েছে, তাদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে।’
বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সহসভাপতি জয় প্রকাশ দাশ বলেন, ‘হাজারী গলিতে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি নিয়ে আমরা দীর্ঘদিন ব্যবসা করে আসছি। বহিরাগতরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে হাজারী গলির কোনো ব্যবসায়ী জড়িত নন। প্রশাসনের নির্দেশে আমরা দোকান বন্ধ রেখেছি। সকাল থেকে প্রশাসনের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে বৈঠক করেছি। আমরা বলেছি, তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক। নিরপরাধ দোকানদার ও কর্মচারীদের যেন ছেড়ে দেওয়া হয়।’
নগর পুলিশের উপকমিশনার রইছ উদ্দিন বলেন, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অপতৎপরতা ঠেকাতে দোকান বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে সব দোকানে এ নির্দেশনা নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিতে যৌথ বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
টাস্কফোর্স-৪-এর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘এসিড নিক্ষেপ হয়েছে। ল্যাব টেস্টের বিষয় রয়েছে। এ জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে দোকানগুলো সিলগালা করা হয়েছে। জড়িতদের শনাক্তের পর দোকানগুলো খুলে দেওয়া হবে।’
৬৮২ জনের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ৪৯
এদিকে যৌথ বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনায় নগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় ৮২ জনের নামে ও অজ্ঞাতপরিচয় অন্তত ৬০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলা করেন কোতোয়ালি থানার এসআই মিজানুর রহমান। নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) কাজী মোহাম্মদ তারেক আজিজ বলেন, ‘৮২ জনকে আটক করা হলেও যাচাই-বাছাই শেষে ৩৩ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আর ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদ
যৌথ বাহিনীর ওপর এসিড নিক্ষেপ ও হামলার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রাম। গতকাল বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশে চবির সহযোগী অধ্যাপক শহীদুল হক বলেন, কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠন আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করছে। একটি ছেলে ইসকনের ব্যাপারে পোস্ট দিয়েছে, পরে ক্ষমাও চেয়েছে। তার পরও কীভাবে দোকানপাট লুট, হামলা হয়? ধর্মীয় উগ্রবাদীরা দেশের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু। তাদের দমন করতে অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক রাসেল আহমেদসহ স্থানীয় সমন্বয়করা উপস্থিত ছিলেন।