দক্ষিণাঞ্চলে কয়েক শ কোটি টাকার তরমুজ পচে যায় সংরক্ষণের অভাবে
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
জেলা প্রতিনিধি,বরিশালঃ
পাঁচ হাজার পিস তরমুজ নিয়ে পটুয়াখালীর দশমিনা থেকে বরিশালে আসেন চাষি লোকমান সরকার। পথেই ৬০০ পিস তরমুজ নষ্ট হয়ে যায়। বাকি তরমুজও সময়মতো বিক্রি করতে হবে। নাহলে সেগুলো নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে। আর বাজারে তরমুজের দামের উত্থান-পতনে নিজেদের লাভ লোকসান নির্ভর করে। লোকমান সরকার বলছিলেন, যখন বাজারে তরমুজের দাম বেশি থাকে তখন এর বেশিরভাগ লাভই করেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। আর যখন একবারে দাম তলানিতে চলে যায় তখন তাদের পথে বসতে হয়। মিনিমাম সাপোর্টিং মূল্যে না পাওয়ায় ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হন তার মতো হাজারো তরমুজ চাষি।
দেশের দুই তৃতীয়াংশ তরমুজ দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদন হয়। বাজারে এর চাহিদা থাকে দুই মাসের মতো। এরমধ্যেই কৃষকের তরমুজ বিক্রি করতে হয়। এরপর তরমুজের সংরক্ষণ সুবিধা না থাকার কারণে প্রতিবছর অনেক তরমুজ নষ্ট হয়ে যায়।
বরিশাল নগরীর নাজিরের পুলের ঢালে তরমুজ বিক্রি করেন সুনীল। সাধারণত ফলের ব্যবসায় সারা বছর থাকলেও মৌসুমে তরমুজ কিনে বিক্রি করেন তিনি। রমজানের শেষদিকে ভালো দাম পাবেন ভেবে ৩০০ পিস তরমুজ কিনেছিলেন আড়ত থেকে। এর মধ্যে ৪৫টি তরমুজ পচে যায়। তিনি বলেন, আমরা ছোট ব্যবসায়ী, অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করি। তরমুজ অতিরিক্ত পরিপক্ব হলেও পচে, আবার গাছ থেকে তোলার পর বেশিদিন রাখলেও পচে যায়। মৌসুমে চাহিদা থাকার কারণে ঝুঁকি নিয়েই তরমুজ ব্যবসা করি।
চাষি লোকমান সরকার কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সুনীল শুধু নয় বরিশাল বিভাগের দশ লাখের বেশি মানুষ তরমুজ সংশ্লিষ্ট বাজার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। মধ্যস্বত্ত্বভোগী ছাড়া প্রায় সকলেই এই ব্যবসায় লোকসানের ঝুঁকিতে থাকেন।বরিশাল বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরমুজ চাষ হয় পটুয়াখালী ও ভোলা জেলায়। মূলত নদীর পলিতে জেগে ওঠা জমিতে তরমুজের ফলন ভালো হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে তথ্যমতে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ৪৬ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে রেকর্ড ৬৪ হাজার ১৮৩ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষ করা হয়েছিল। সে বছর বিভিন্ন জেলার শত শত চাষি তাদের তরমুজ বরিশাল পোর্ট রোড মোকামে এনে দাম না পেয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। যার কারণে ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আবাদ হয়েছে ৪৬ হাজার ৮৪৫ হেক্টর জমিতে। এ মৌসুমে আবাদ কমলেও তরমুজের বাজার দর ভালো।
ভোলার ভেলুমিয়া ইউনিয়নের তরমুজ চাষি ইসমাইল মীর বলেন, গত বছর ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু অসময়ের বৃষ্টিতে পানিতে ডুবে লোকসানে পড়তে হয়। সেবার পানির দাম দিয়েও ক্রেতা পাইনি। খুচরা বাজারে যে তরমুজটি বিক্রি হয়েছে দেড় থেকে দুইশ টাকায়, আমরা সেটি ৫০/৬০ টাকাও বিক্রি করতে পারিনি।
বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার চর লড়াইপুরের বাসিন্দা মিলন মাঝি বলেন, গত বছর লোকসান হওয়ায় এবার তরমুজ চাষ কমিয়ে দিয়েছি। তবে এবার বাজার দর ভালো আছে। গত বছরের লোকসানের ক্ষতি হয়ত কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু বাজারের এমন উত্থান-পতনের কারণে কৃষক বেশিরভাগ সময় লোকসানে পড়েন।
দুইমাসে ১০০০ কোটি টাকার বাজার- গ্রীষ্ম ঋতুকে ঘিরে তরমুজের মৌসুম হওয়ায় ৬০/৬১ দিন তরমুজ বাজারে পাওয়া যায়। এ সময়ে বরিশাল বিভাগ থেকে সারাদেশে তরমুজ চালান হয়। সারাদেশের তরমুজ ব্যবসায়ীরা এসে ভিড় করেন এই অঞ্চলের কৃষকের বাড়ি, স্থানীয় বাজারেও আড়তে। পিস হিসেবে কিনে নিয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তা বিক্রি করেন বিভিন্ন এলাকায়। তরমুজের বাজার মনিটরিং করে থাকে বাংলাদেশ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় অফিস। প্রতি সপ্তাহে এই অধিদপ্তরটি বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে।
বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বরিশাল বিভাগে ৯৫৩ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে। সে বছর তরমুজের কেজি ধরা হয় ৩৫/৪০ টাকায়। চলতি (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে এখন পর্যন্ত চাষের ৫২ শতাংশ বাজারজাত হওয়ায় ৪৭১ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি হয়েছে। বৈরী আবহাওয়া না হলে শেষ সময়ে বাকি ৪৮ শতাংশ তরমুজ ৫৫০ কোটি টাকার ব্যবসা করবে। এ মৌসুমে তরমুজের বাজারমূল্যে বিবেচনা করা হচ্ছে ৫৫/৬০ টাকা কেজি।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক এসএম মাহবুব আলম বলেন, চলতি মৌসুমে বিভাগের ছয় জেলায় কমপক্ষে ১০০০ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলের মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া অনুকূল হওয়ায় তরমুজ সম্ভাবনাময় ফসল। বিশেষ করে ভোলা ও পটুয়াখালী জেলায় প্রচুর তরমুজ হয়। কিন্তু তরমুজের বাজার সংক্ষিপ্ত হওয়ায় সংরক্ষণের অভাবে এর সঠিক বাজারমূল্য পান না কৃষক।
সংরক্ষণাগার উদ্ভাবনের দাবি- পটুয়াখালীর বাউফলের কালাইয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ইমরান বলেন, পাঁচ লাখ টাকার তরমুজের চালান এনেছিলাম বরিশালে। আমার আড়াই লাখ টাকার তরমুজ নষ্ট হয়ে গেছে। তরমুজ সংরক্ষণের যদি ব্যবস্থা থাকত তাহলে দুইমাসের মধ্যে বাধ্যতামূলক তরমুজ বিক্রি করতে হতো না। সারা বছর হিমাগারে রেখে বিক্রি করতে পারতাম।তিনি বলেন, সংরক্ষণের কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার না হওয়ায় প্রতি বছর কয়েক শ কোটি টাকার লোকসান হয় তরমুজ চাষিদের।
দশমিনার চাষি লোকমান সরকার বলেন, বিভাগে যদি ১০ লাখ চাষি থাকেন তাহলে সেই ১০ লাখ চাষি প্রতি বছর শত কোটি টাকার লোকসানে থাকেন। সংরক্ষণাগারের ব্যবস্থা থাকলে তরমুজের বাজার এত অস্থির হতো না। কৃষকের সুবিধামতো সারাবছর বিক্রি করতে পারতেন। এতে ক্রেতাও যেমন সারা বছর তরমুজ খেতে পারতেন, চাষিরাও বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে পারতো পর্যায়ক্রমে।
তিনি বলেন, আলু নিয়েও কিন্তু একসময়ে এমন পরিস্থিতি ছিল। এরপরে কোল্ডস্টোরেজ এলো। এখন সারাবছর আলু খাওয়া যাচ্ছে। তেমনি তরমুজ কোন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা যায় তা নিয়ে কাজ করা উচিত। সরকার এই বিষয়টিতে নজর দিলে কৃষক বাঁচবে।
যা বলছে কর্তৃপক্ষ- আবহাওয়ার প্রতিকূলতা, তরমুজ গাছে রোগের সংক্রমণ ও একই জমিতে প্রতি বছর তরমুজ চাষ করায় উর্বরতা নষ্ট হয়ে গত বছরের তুলনায় এ মৌসুমে ফলন কম হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরিশাল অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ শওকত ওসমান। তিনি বলেন, এটা স্বীকার করতেই হবে অন্য ফসলের তুলনায় দক্ষিণাঞ্চলে তরমুজ চাষ লাভজনক এবং অতি উচ্চমূল্যের ফসল। বাজার চাহিদা ও মূল্য ভালো থাকায় কৃষকরা অতি সহজে লাভবান হতে পারে।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভালো ফলন করেও কৃষক তার উৎপাদিত ফসল সরাসরি বাজারে বিক্রি করতে পারছে না। মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে কৃষকের চেয়ে বেশি লাভ নিয়ে নিচ্ছে তারা। এ ছাড়া তরমুজের প্রক্রিয়াজাতকরণ কিংবা সংরক্ষণের কোনো পদ্ধতি এই অঞ্চলে এখনো গড়ে ওঠেনি। এজন্য খুবই সম্ভাবনাময় ফসল তরমুজে লোকসান হচ্ছে কৃষকের। সরকার চাইছে তরমুজের কিছু প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে উঠুক।
তিনি বলেন, তরমুজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে কৃষক বাধ্য হয়ে লোকসানে তরমুজ বিক্রি করতেন না। তরমুজসহ এ অঞ্চলে উৎপাদিত যে ফসলগুলো মৌসুমে চড়ামূল্য থাকে সেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। সংরক্ষণ ব্যবস্থা হলে সকল সংকটের সমাধান হবে।