দানের প্রতিশ্রুতি পেলেও নেওয়া যাচ্ছে না কর্নিয়া

প্রকাশিত: ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ২, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজধানীর মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান। থাকেন আশুলিয়া বাইপাইল সড়ক এলাকায়। গত ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়া থানার সামনে পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন মিজান। বর্তমানে তিনি রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল শুক্রবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৪১৬ নম্বর ওয়ার্ডের ২৯ নম্বর শয্যায় শুয়ে আছেন।

সম্প্রতি মিজানের চোখে অস্ত্রোপচার করে গুলি বের করা হয়েছে। সেই গুলি টেপ দিয়ে লাগিয়ে রাখা হয়েছে তাঁর ব্যবস্থাপত্রে। তাঁর শয্যাপাশে গেলে ব্যবস্থাপত্র দেখিয়ে বলেন, ‘গুলি লাগার পর থেকে আমি ডান চোখে দেখতে পাই না। নিদারুণ যন্ত্রণা ছিল। গুলি বের করায় যন্ত্রণা কমেছে। আশার কথা হলো, স্যার (হাসপাতাল পরিচালক) বলেছেন, কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হবে। তবে এক মাস আগে এ কথা বললেও সুনির্দিষ্ট কিছু এখনও জানায়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।’
একই রকম অবস্থা কলেজছাত্র আমিনুল ইসলাম শুভর। গত ১৬ জুলাই সিরাজগঞ্জ শহরে আন্দোলন চলার সময় পুলিশের ছররা গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। তাঁর চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি ডান চোখে দেখতে পেলেও বাঁ চোখে মোটেও দেখতে পাচ্ছেন না। বর্তমানে চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। তাঁরও এক চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন প্রয়োজন, তবে মিলছে না।
শুধু মিজান ও শুভর ক্ষেত্রেই সমস্যা হচ্ছে না। প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার মানুষের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। বর্তমানে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বে ভুগছেন দেশের ৫ লাখ মানুষ। তবে সরকারিভাবে কর্নিয়া সংগ্রহে কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ নেই। বেসরকারিভাবে সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি মরণোত্তর কর্নিয়া সংগ্রহে কাজ করে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, গত ৩৮ বছরে তাদেরকে মরণোত্তর কর্নিয়া দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার মানুষ। নিবন্ধিত ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র ১৫০ জনের কর্নিয়া নেওয়া সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে সারাদেশে সাড়ে চার হাজার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বছরে সব মিলিয়ে ৩০০ জনের কর্নিয়া স্থাপন করা সম্ভব হয়। অধিকাংশ কর্নিয়া দেশের বাইরে থেকে আনা।

এ পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় স্বেচ্ছায় রক্তদান ও মরণোত্তর চক্ষুদান দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘এসো প্রাণের ছোঁয়ায় গড়ি রক্তের বন্ধন, চোখের জ্যোতি হয়ে উঠুক প্রাণের স্পন্দন’। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
মরণোত্তর চক্ষুদান কার্যক্রমে যুক্ত বিশেষজ্ঞরা বলেন, মরণোত্তর অঙ্গদানে আইনি জটিলতা, ধর্মীয় বাধা, সচেতনতার অভাবে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হলে ভবিষ্যতে অনেকের চোখের আলো ফিরিয়ে দেওয়া যাবে মরণোত্তর চক্ষুদানের মাধ্যমে।

সন্ধানীর জাতীয় চক্ষুদান সমিতির সমন্বয়ক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘গত তিন মাসে মরণোত্তর চক্ষুদানে নিবন্ধিত প্রায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমরা তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কর্নিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরিবারের অনুমতি ছাড়া মরণোত্তর অঙ্গ নেওয়া সম্ভব নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণরা পরিবারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই মরণোত্তর অঙ্গদানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। যে কারণে মৃত্যুর পর তাদের অঙ্গ নেওয়া সম্ভব হয় না।’

ভিশন আই হাসপাতালের কর্নিয়া বিশেষজ্ঞ ও সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মাসুদ হাসান বলেন, অন্যান্য দেশে হাসপাতালে মারা যাওয়া ব্যক্তি থেকে কর্নিয়া সংগ্রহের বিধান রয়েছে। তবে আইনি জটিলতায় এ ব্যবস্থা বাংলাদেশে করা সম্ভব হয়নি। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সন্ধানীর জাতীয় চক্ষুদান সমিতি চাইলেই কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারে না। বেসরকারি সংগঠন দিয়ে এ ধরনের বড় কাজ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করার উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ সালে প্রণীত আইনের সংশোধন প্রয়োজন। এ আইনের ধারা ৪-এ দাতার মরদেহ থেকে ব্রেইন ডেথ ঘোষণার পর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের বিধান আছে। কর্নিয়া সংগ্রহের জন্য এমন ধারা প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়। বিশেষ করে স্বাভাবিক মৃত্যু বা বায়োলজিক্যাল ডেথ হওয়ার পর ছয় ঘণ্টার মধ্যে চোখ বা কর্নিয়া সংগ্রহ করে ব্যবহার করতে হয়। এ আইন অনুযায়ী মৃত্যু হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি কেউ মৃতদেহ দাবি না করে, তাহলে কর্তৃপক্ষের যথাযথ অনুমতি নিয়ে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের বিধান রয়েছে।

কর্নিয়া সংকটের কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ইউনিট। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দৃষ্টি হারানো দু’জনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কর্নিয়া দুটি নেপাল থেকে বিনামূল্যে পেয়েছে সরকার।
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আন্দোলনে আহত হয়ে দৃষ্টি হারানো ৬৬ জনের কর্নিয়া প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। ধাপে ধাপে আমরা তাদের চোখে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করব। প্রথম দফায় দু’জনের করা হয়েছে। আরও ছয়জনকে অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে। সুযোগ ও প্রয়োজন বিবেচনায় অন্যদেরও করা হবে।’