দেশে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা: চলতি বছরে ৩৬১ শিক্ষার্থীর মৃত্যু

প্রকাশিত: ১:৫২ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১০, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
দেশে পারিবারিক-সামাজিক অবক্ষয়সহ নানান ইস্যুতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গত ৮ মাসে ৩৬১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তাদের মধ্যে স্কুল শিক্ষার্থী ১৬৯ জন, কলেজ শিক্ষার্থী ৯৬ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৬৬ জন এবং মাদরাসা শিক্ষার্থী ৩০ জন। একই সময়ে ১৪৭ জন পুরুষ শিক্ষার্থী ও ২১৪ জন নারী শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। গত বছর ২০২২ সালের ৮ মাসে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৩৬৪ জন। বিষেশজ্ঞরা বলছেন, অভিভাবক-শিক্ষকদের অসচেতনতার কারণেই অনাকাঙ্খিত এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। আত্মহত্যার প্রবণতা ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষার্থীসহ কোমলমতি শিশুদের সাথে অভিভাবকদের বন্ধুসুলভ আচরণ করতে হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের আরও বেশি যতœশীল হতে হবে। শিক্ষার্থীদের ডাকে সহানুভ‚তি প্রদর্শন এবং সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবার-অভিভাবকদের আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে যুগপৎভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আজ শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকালে আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ক্রমবর্ধমান: কোন পথে সমাধান? শীর্ষক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ ও ওয়েবিনারে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
এতে জানানো হয়, ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে। এ বিভাগে আত্মহত্যা করে ৩১ দশমিক ৩০ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিভাগে আত্মহত্যা করে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। রাজশাহী বিভাগে আত্মহত্যা করে ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। খুলনা বিভাগে আত্মহত্যা করে ১৩ শতাংশ। রংপুরে বিভাগে আত্মহত্যা করে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। বরিশালে আত্মহত্যা করে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। এছাড়া সিলেটে আত্মহত্যা করে ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ময়মনসিংহ বিভাগে আত্মহত্যা করে ১০ শতাংশ।
আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৯ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী গত আট মাসে আত্মহত্যা করেছে। অপরদিকে, ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
নারী শিক্ষার্থীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ খতিয়ে দেখা যায়, ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী অভিমান করে, প্রেমঘটিত কারণে ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, পড়াশোনার চাপ ও ব্যর্থতার কারণে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ, পারিবারিক বিবাদের কারণে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ, যৌনহয়রানির কারণে ৫ দশমিক ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তর বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা। মোট আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীদের ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশই ছিল স্কুলগামী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১১২ জন এবং পুরুষ শিক্ষার্থী ছিল ৫৭ জন। এছাড়া আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিল ২৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল ১৮ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং আত্মহননকারীদের মাঝে মাদরাসার শিক্ষার্থী রয়েছে ৮ দশমিক ৩১ শতাংশ।
আত্মহত্যাকারীদের বয়সভিত্তিক বিবেচনায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা। এই বয়সী ছিল ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ছিল ১৫৯ জন। অন্যদিকে পুরুষ শিক্ষার্থী ৮৪ জন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ২০ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২১ দশমিক ৬ শতাংশ। ২৬ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ২ দশমিক ৮০ শতাংশ। ১ থেকে ১২ বছরের শিক্ষার্থী ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আঁচল ফাউন্ডেশনের গবেষক দল আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণ করে দেখেছেন শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ৩১ দশমিক ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী ৫৭ জন এবং সমসংখ্যক পুরুষ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়াও আত্মহত্যার পেছনে আরও বেশ কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন তারা, যেমন- প্রেমঘটিত কারণ, পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অ্যাকাডেমিক চাপ, মানসিক অস্থিতিশীলতা, পারিবারিক সমস্যা এবং অন্যান্য।
প্রেমঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৫ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী। পারিবারিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যা করেছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। মানসিক অস্থিতিশীলতার কারণে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী এবং ৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে অ্যাকাডেমিক চাপের কারণে।
ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার কারণে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা কম থাকার কথা থাকলেও, সেখানেও দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। গত আট মাসে মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মাঝেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ৩৬১ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ জন মাদরাসার শিক্ষার্থী আত্মহনন করেছে। তাদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী ছিল। আর পুরুষ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। আত্মহত্যাকারী মাদরাসার শিক্ষার্থীদের মাঝে ৪০ শতাংশের পেছনে দায়ী ছিল অভিমান। রোমান্টিক সম্পর্কের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ১৩ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ১০ শতাংশের আত্মহত্যার পেছনে যৌন নির্যাতন দায়ী।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আঁচল ফাউন্ডেশন ১১ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- আত্মহত্যা মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে একটি টোল ফ্রি জাতীয় হটলাইন নম্বর চালু করা, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ অনুভ‚তি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানো, শিক্ষার্থীদের নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশল, স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট এবং মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো, পরিবারে, সমাজে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের সহানুভ‚তি এবং সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিতে হবে, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবার-অভিভাবকদের আত্মহত্যা সতর্কতা চিহ্ন সম্পর্কে ধারণা বিস্তৃত করা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে যুগপৎভাবে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা।
এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো ইন্স্যুরেন্সের আওতায় আনা, গণমাধ্যমে দায়িত্বপূর্ণ প্রতিবেদন লেখা ও প্রকাশ করা, বাবা মা এবং সন্তানের মাঝে মানসিক দূরত্ব কমাতে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করা ও প্রতি ৩ মাস অন্তর অন্তর সব শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য স্ক্রিনিং বাধ্যতামূলক করা।
ওয়েবিনারে উপস্থিত ছিলেন হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিন, অতিরিক্ত ডিআইজি, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার শহীদুল ইসলাম ও আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
ডা. হেলাল উদ্দীন আহমদ বলেন, এতজন শিক্ষার্থী যে আত্মহত্যা করেছে সেটার জন্য আমাদের উচিত তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মনোযোগী হওয়া। তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষকদের নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দায়িত্বশীল হতে হবে যেন তারা শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যতœবান হতে পারেন।
আত্মহত্যার প্রবণতা সম্পর্কে তিনি বলেন, যে আত্মহত্যা করে সে মরে না। এ ধরনের কথা যারা বলে তাদের প্রতি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কেউ একা থাকছে, খাবার টেবিলে খেতে আসছে না। একা থাকছে, রাত জাগছে এ ধরনের ক্ষেত্রে সন্তানকে গুণগত সময় দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ডিস্ট্র্যাকটেড প্যারেন্টিং যেন না করি। নিজেকে ভালো না রাখতে পারলে, সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা সম্ভব না।
এ বিষয়ে তানসেন রোজ বলেন, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব অনেক বেশি। এটা কমাতে আমাদের কাজ করা দরকার। বর্তমান প্রজন্ম অনেক ভঙ্গুর। ঠুনকো কারণে তারা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। গত বছর প্রেমে ব্যর্থতার কারণে আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল বেশি, এবার অভিমানের কারণে। এখানে শিক্ষক ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য সুস্থ বিনোদন ও খেলাধুলার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এদিকে এ বিষয়ে ডিআইজি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা না বুঝেই পড়াশোনার জন্য চাপ দেন। এটা ঠিক না। পরিসংখ্যানে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা খুবই ভয়াবহ। আবার নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে যা খুবই দুঃখজনক। এখনকার শিক্ষার্থীরা অনেক ব্রিলিয়ান্ট। বিশ্বায়নের যুগে তারা এগিয়ে। কিন্তু শিক্ষকরা অনেক পিছিয়ে আছে। দেখা যায়, শিক্ষকরা এমন কিছু বলছেন যাতে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আবার অনেক শিক্ষক কিন্তু শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যান। আত্মহত্যার প্রবণতারোধে শিক্ষক-অভিভাবকদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণের মাধ্যমে তার স্বপ্ন-আকাঙ্খা বা চাহিদা কী তা জানতে হবে এবং বাস্তবায়নেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া মাঝেমধ্যেই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ পরিহার করে নিজেকে স্বাবলম্বিভাবে গড়ে তুলতে এবং স্বাভাবিক জীবনে বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা ও পরামর্শ দিতে হবে।