নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি:
নারায়ণগঞ্জ জেলায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের নজির দিন দিন বেড়ে চলেছে। এতে পুলিশ-প্রশাসন নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও এই অবৈধ ব্যবহার যেন থেমে নেই। সম্প্রতি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের প্রার্থী এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মিছিলে বৈধ অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। এই ঘটনায় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে জনমনে শঙ্কা তত বাড়ছে। এদিকে নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রায় সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে ২৬৪টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল ও ট্রান্সফার করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে ব্যক্তিগত ও কোম্পানি প্রতিষ্ঠানের মোট ৭৩৭টি অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। তবে ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই পর্যন্ত মোট অস্ত্রের লাইসেন্স সংখ্যা ছিল এক হাজার একটি। সে হিসেবে এই সময়ের মধ্যে জেলায় ২৬৪টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল ও পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বন্দুক ও শর্টগান, পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, ‘বর্তমানে অস্ত্র লাইসেন্স সংখ্যা ৭৩৭টি। অনেক অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। তাছাড়া গত কয়েক বছরে কেন অস্ত্রের লাইসেন্স সংখ্যা কমেছে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।’
খোঁজ নিয়ে ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৫–৭০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন ২০টি বন্দুকের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার এবং তারপর জিয়াউর রহমান সরকার আমলেও বন্দুকের লাইসেন্স দেওয়া হয় যথাক্রমে ২৪টি ও ৮১টি। এরশাদ সরকারের আমলে ৯ বছরে নারায়ণগঞ্জে ২০৬টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়; যার ২১টি হলো রাইফেল আর ৫০টি পিস্তল–রিভলবার। বাকিগুলো বন্দুক। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তাদের পাঁচ বছরে এ জেলায় ৮৯ জন অস্ত্রের লাইসেন্স পান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরে ২৩৮ জনকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
বিএনপি ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসার পর তখনকার দলীয় সাংসদ গিয়াস উদ্দিন একটি পিস্তল ও একটি বন্দুকের লাইসেন্স নেন। তবে ওই সময়ে ঠিক কতগুলো অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে সেই তথ্য সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। আর ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাকি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
১৯৭২ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে যারা অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী, জনপ্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ব্যক্তি। এরশাদ সরকারের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তিও অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির দুই জন, আওয়ামী লীগের চার, বিএনপির একজন ও জাসদের একজন রয়েছেন।
এদিকে আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে বেড়েছে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার। গত ২৯ নভেম্বর বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল করে রূপগঞ্জ উপজেলায় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। সেই মিছিলে কাঞ্চন পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল কলির দেহরক্ষী আশিকুজ্জামান প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে গোলাম দস্তগীর গাজীকে শোকজ করা হয়। এবং সেই অস্ত্রটি লাইসেন্সসহ পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। একইসাথে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রদর্শন করা অস্ত্রটির লাইসেন্স বাতিল করা হয়। যদিও সেই অস্ত্রটির লাইসেন্স নড়াইল জেলা থেকে করা হয়েছিল। তবে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অস্ত্রটির লাইসেন্স বাতিলের জন্য চিঠি পাঠিয়েছিলেন।
পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর ওপর সশস্ত্র হামলার সময় প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে ধরা নিয়াজুল ইসলামের সেই অস্ত্রের লাইসেন্স (নিবন্ধন) বাতিল করা হয়েছে। চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাহমুদুল হক তার অস্ত্রের লাইসেন্সটি বাতিল করেন। নিয়াজুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি।
২০১৪ সালের ৬ মে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলার জের ধরে ওই মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার ঘনিষ্ঠ সাত জনের ১১টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। তৎকালীন ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেন ও তার ঘনিষ্ঠ সাত জনকে ওই ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। এর মধ্যে নূর হোসেনের দুটি (একটি রাইফেল ও একটি পিস্তল), তার ভাই মো. নূরুউদ্দিন মিয়ার একটি (শটগান), ভাতিজা ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহজালাল বাদলের দুটি (শটগান ও পিস্তল), নূর হোসেনের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে পরিচিত মো. শাহজাহান, দেহরক্ষী আলী মোহাম্মদ, সানাউল্লাহ ও জামালউদ্দিনের একটি করে (শটগান) এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত ও সিদ্ধিরগঞ্জ কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুল হকের দুটি (শটগান ও রিভলবার) অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে।
এসব লাইসেন্স বাতিলের জন্য নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওই সময় লিখিতভাবে জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের সংখ্যা খুবই কম। মূলত অস্ত্রের লাইসেন্স অনেকে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ট্রান্সফার করে ফেলে। অথবা অনেকে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করে। এ ছাড়া নতুন অস্ত্রের লাইসেন্স কম দেওয়া হয়, এ কারণে অস্ত্রের লাইসেন্সের সংখ্যা বাড়ছে না।
বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, ইতোমধ্যে রূপগঞ্জে বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনায় লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রের নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালা কেউ লঙ্ঘন করলে তা বাতিল করা হবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে।
তবুও নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাদের বক্তব্যে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার ও ভীতি সৃষ্টির বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার, ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়াসহ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নৌকার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্যের মুখে এ নিয়ে নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে।