পশ্চিমাঞ্চলে এক বছরে ৩৫৭ স্থানে ভেঙেছে রেললাইন

প্রকাশিত: ১২:৪৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২৫

রাজশাহী প্রতিনিধি:

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পুরো রেলপথের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার। ২০২৪ সালে বছরজুড়ে এই পথে ৩৫৭ স্থানে ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ অঞ্চলের রেললাইন। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সবচেয়ে রেললাইন ভাঙার ঘটনা বেশি ঘটেছে। এই অঞ্চলে শুধু হিলি সেকশনেই ১২১ স্থানে ভেঙেছে।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলপথের বয়স হয়েছে, ক্ষমতা কমেছে। প্রচণ্ড শীত, গ্রীষ্মের দাবদাহ এসব কারণে ভাঙছে লাইন। শীতের কারণে লাইন সংকুচিত হয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটে। এছাড়া গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ ও গরমেও রেললাইন ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। যদিও রেললাইন ভাঙার কারণ বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে ট্রেন চলাচলে সময় বিভ্রাটের ঘটনা ঘটেছে। তবে নতুন রেললাইন স্থাপনে দুটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। নতুন রেললাইন এলে এই সমস্যা আর থাকবে না।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পুরো ১ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার পথ দুই সেকশনে ভাগ করা হয়েছে। রাজশাহী-জয়দেবপুর সেকশন প্রকৌশলী বিভাগ-২ এর আওতায় রয়েছে। বছরজুড়ে এই সেকশনে ৩১৮ স্থানে রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। প্রকৌশলী বিভাগ-২ তে সবচেয়ে বেশি রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে হিলি সেকশনে। এই সেকশনে বেশি রেললাইন ভেঙেছে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে।

জানা গেছে, এ রেলপথে কোথাও স্লিপার ভাঙা, কোথাও উঠে গেছে ক্লিপ, কোথাও সঠিক পরিমাণে নেই পাথর। এতে কমছে ট্রেনের গতি, বিভ্রাট হচ্ছে সময়সূচির, ভোগান্তিতে পড়ছেন যাত্রীরা। রেল বিভাগের ভাষ্য, অন্তত ৬০ ভাগ রেলপথই পুরোনো হওয়ায় কমেছে সক্ষমতা। প্রচণ্ড শীত ও গরমে ভাঙছে লাইন। অনেক স্থানে লাইনের ওপর ট্রেন উঠতেই দেবে যায় স্লিপার। কোথাও স্লিপার ভাঙা, কোথাও ক্লিপ উঠে গেছে স্লিপার থেকে। কোথাও উঁচু-নিচু আবার কোথাও নেই সঠিক পরিমাণে পাথর। ফলে লাইন ভাঙা, রেল লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। কমছে ট্রেনের গতি। বিভ্রাট হচ্ছে সময়সূচির।

এছাড়া খুলনা-রাজবাড়ী মিলে প্রকৌশলী বিভাগ-১ এর আওতায় রয়েছে। বছরজুড়ে এই সেকশনে ৪০ স্থানে রেললাইন ভাঙেছে। প্রকৌশলী বিভাগ-১ সবচেয়ে বেশি রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে ১২টি মোবারকগঞ্জ সেকশনে। এই সেকশনে সবচেয়ে বেশি রেললাইন ভেঙেছে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে।প্রকৌশলী বিভাগ-২ এর আওতায় পড়ে ৯টি সেকশন। এই সেকশনে ৩১৮ স্থানে রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে- জয়দেবপুরে ১৭, সিরাজগঞ্জ বাজার সেকশনে ৫৯, ঈশ্বরদী সেকশনে ৩৯, সান্তাহার সেকশনে ১৮, হিলি সেকশনে ১২১, পার্বতীপুর সেকশনে ১৮, সৈয়দপুর সেকশনে ২০, রাজশাহী সেকশনে ২৬ স্থানে রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরার পুরো সেকশনে বছরজুড়ে কোনো লাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেনি। মাসের চিত্রে জানুয়ারিতে ৪৩টি স্থানে রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৩৬, মার্চে ৩৩, এপ্রিলে ১৯, মে মাসে ১৭, জুন মাসে ২০, জুলাই মাসে ১১, আগস্ট মাসে ১৪, সেপ্টেম্বরে ২৯, অক্টোবরে ২১, নভেম্বরে ২৮ ও ডিসেম্বরে ৪৭ স্থানে রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে।

এছাড়া জয়দেবপুরে পুরো বছরে ১৭টি স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারি ও আগস্ট মাসে দুই জায়গা করে চার স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। বছরটির সেপ্টেম্বর ও ডিসেম্বর মিলে ৫ জায়গা করে ১০ স্থানে ভেঙেছে। এছাড়া অক্টোরে ৩ স্থানে ভেঙেছে, সিরাজগঞ্জ বাজার সেকশনে ৫৯ স্থানে ভেঙেছে রেললাইন। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৩, ফেব্রুয়ারিতে ১০, মার্চে ৬, এপ্রিলে ৫, মে মাসে ১, জুনে ৬, জুলাই মাসে ৩, আগস্টে ৬, সেপ্টেম্বর মাসে ৮, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে ২ এবং ডিসেম্বর মাসে ৯স্থানে ভেঙেছে রেললাইন। ঈশ্বরদী সেকশনে ৩৯ স্থানে ভেঙেছে রেললাইন। এরমধ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ৬টি করে ১২ স্থানে ভেঙেছে লাইন। মার্চে ১, এপ্রিলে ৩, মে মাসে ৫, জুন মাসে ৩, জুলাই ও আগস্ট মাসে ২, সেপ্টেম্বরে ৩, অক্টোবরে ২, নভেম্বরে ৩, ডিসেম্বর মাসে ৫ স্থানে ভেঙেছে রেললাইন।

অপরদিকে, সান্তাহার সেকশনে ১৮ স্থানে ভেঙেছে রেললাইন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২, ফেব্রুয়ারিতে ১, মে ও জুনে ২. আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ৩, নভেম্বর ৪ এবং ডিসেম্বর ৬ স্থানে লাইন ভাঙেছে। হিলি সেকশনে ১২১ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ১৩, ফেব্রুয়ারিতে ৪, মার্চে ২১, এপ্রিল ১০, মে মাসে ৮, জুন মাসে ৭, জুলাই মাসে ৫, আগস্ট মাসে ১, সেপ্টেম্বরে ৬, অক্টোবরে ১১, নভেম্বরে ১৭, ডিসেম্বরে ১৮ স্থানে ভেঙেছে। পার্বতীপুরে ১৮ স্থানে ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৫, ফেব্রুয়ারিতে ৪, মার্চে ১, মে মাসে ১, সেপ্টেম্বর মাসে ৩, অক্টোবরে ১, নভেম্বরে ২ ও ডিসেম্বরে ১ স্থানে ভেঙেছে। সৈয়দপুরে ২০ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৭, ফেব্রুয়ারিতে ৯, মার্চ-এপ্রিলে ২, জুনে ১, সেপ্টেম্বরে ১ স্থানে লাইন ভেঙেছে। রাজশাহী সেকশনে ২৫ স্থানে লাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৫, ফেব্রুয়ারিতে ২, মার্চে ৩, মে মাসে ১, জুন মাসে ২, জুলাই মাসে ২, আগস্ট মাসে ৩, সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ৪ স্থানে, নভেম্বরে ১ এবং ডিসেম্বরে ২ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে।

প্রকৌশলী বিভাগ-১ এর আওতায় পড়ে ৮টি সেকশন। এই সেকশনে ৪০ স্থানে রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে খুলনায় ৫, যশোর সেকশনে ৯, মোবারকগঞ্জ সেকশনে ১২, চুয়াডাঙ্গা সেকশনে ৭, ভেড়ামারা সেকশনে ৪ এবং কুষ্টিয়া সেকশনে ৩ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। তবে নলিয়াগ্রাম ও রাজবাড়ী সেকশনে বছরজুড়ে কোনো রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেনি। মাসের হিসেবে জানুয়ারিতে ৮টি স্থানে রেল লাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ৮, মার্চে ৪, মে মাসে ২, জুন মাসে ৩, জুলাই মাসে ৩, আগস্ট মাসে ১, সেপ্টেম্বর মাসে ৪, অক্টোবর মাসে ৩, নভেম্বর মাসে ২ এবং ডিসেম্বর মাসে ২ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে।

খুলনা সেকশনে ৫ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ২, মার্চে ২, অক্টোরে ১ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। যশোর সেকশনে ৯ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ৩, ফেব্রুয়ারিতে ২, মার্চে ১, মে মাসে ২, অক্টোবরে ১ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। মোবারকগঞ্জ সেকশনে ১২ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ২ করে ৪ স্থানে। এছাড়া মার্চে ১, সেপ্টেম্বরে ৪, অক্টোবরে ১, নভেম্বরে ২ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। চুয়াডাঙ্গা সেকশনে ৭ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ১, জুনে ৩, জুলাইয়ে ২, আগস্টে ১ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। ভেড়ামারা সেকশনে ৪ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ২, জুলাই ও ডিসেম্বরে ১ জায়গা করে দুই স্থানে ভেঙেছে। কুষ্টিয়া সেকশনে ৩ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে। এরমধ্যে জানুয়ারিতে ২ এবং ডিসেম্বরে ১ স্থানে রেললাইন ভেঙেছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মধ্যে গত ৩১ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) স্টেশনে রেললাইন ভেঙে যায়। ওই মাসের ৮ তারিখে একই স্থানে লাইন ভেঙেছিল। গেল বছর রাজশাহী সেকশনে অন্তত ২৫টি স্থানে এমন রেললাইন ভাঙার ঘটনা ঘটেছিল। গত ৮ ডিসেম্বর নাটোরের লালপুরে আজিমনগর স্টেশন এবং আব্দুলপুর জংশনের মধ্যবর্তী বিহারিপাড়া এলাকায় রেললাইন ভেঙে যায়। গত ৬ জুলাই রাজশাহী নগরীর বুধপাড়া গনির মোড় রেলক্রসিংয়ে (৫৮ নম্বর রেলব্রিজ) ট্রেনের লাইন ভেঙে গেছে। স্থানীয়দের ধারণা রাতের কোনো এক সময় ট্রেনের লাইনটি ভেঙে গেছে। গত ৮ জুন নাটোরের বাগাতিপাড়ায় রেললাইন ভাঙে যায়। গত ২৭ নভেম্বর নাটোরের লালপুরে রেললাইন ভেঙে যায়। গত ৩১ আগস্ট নাটোরের লালপুরে আজিম নগর ও আব্দুলপুর সেকশনের মধ্যবর্তী এলাকায় রেললাইন ভাঙা দেখে লাল কাপড়ের নিশানা উড়িয়ে ট্রেন থামিয়ে দেন এলাকাবাসী। গত ২৮ নভেম্বর নাটোরে রেললাইনে ফাটলে আজিমনগর স্টেশন ও আব্দুলপুর জংশনের মধ্যবর্তী নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস সংলগ্ন বিহারীপাড়া রেলগেটের অদূরে রেললাইনে ভাঙে যায়। গত ৮ মে নাটোরের বাগাতিপাড়ায় রেললাইনে ভাঙে যায়। গত ১৪ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও-ঢাকা রেল রুটে রেললাইন ভেঙে যাওয়ায় ৩ ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেললাইনের কয়েকজন কি ম্যান বলেন, স্লিপার ভাঙা, কোথাও উঠে গেছে ক্লিপ। বেশিরভাগ জয়েন্টের ফিস প্লেটের ঘাট বড় হয়ে গেছে। এছাড়া বুলেটগুলো কাঁচা লোহার। বেশি টিকে না। নাট-বল্টুগুলো যন্ত্র দিয়ে টাইট দিলেও পরের দিন এসে খোলা অবস্থায় থাকে। অনেক সময় ফিস প্লেটের বোল্টগুলো হারিয়ে যায়। আমরা বারবার কর্তৃপক্ষকে জানায়। তারা কেমন ব্যবস্থা নেয় না।

পশ্চিমাঞ্চল রেলে বর্তমানে ১২৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। ঈশ্বরদী জয়দেবপুর রুটে ২৩টির সক্ষমতায় ৪০টি, ঈশ্বরদী পার্বতীপুর রুটে ২২টির সক্ষমতায় ৩৬টি, ঈশ্বরদী খুলনা রুটে ২৮টির সক্ষমতায় ২৬টি, শান্তাহার লালমনিরহাট রুটে ৩২টির সক্ষমতায় ৩৭টি, পোড়াদাহ-ভাঙ্গা রুটে ৩২টির সক্ষমতায় ২২টি ট্রেন চলাচল করে।

এ বিষয়ে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মামুনুল ইসলাম বলেন, রেলওয়ের বয়স হয়েছে। রেললাইনগুলো অনেক পুরাতন। কোনোটা রেললাইন স্বাধীনতারও আগের। মোবারকগঞ্জের রেলওয়ে অনেক পুরানো। প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আমাদের দায়িত্বে যে-সব রেললাইন আছে, সেগুলো কোনো জায়গায় ভেঙে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করা হয়। ফলে সময় বিলম্ব হচ্ছে। কিন্তু বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। রেলে সংকোচনের তারণে ভেঙে থাকে। সাধারণত জয়েন্টে ভাঙে। আবার স্লিপারের কারণে কিছু ভাঙে।