ডেস্ক রিপোর্ট:
বিশ্ববাজারে গত দেড় বছরে গমের দাম অনেকটা কমলেও দেশের বাজারে পণ্যটি থেকে উৎপাদিত আটা-ময়দা ও বেকারি-হোটেলে প্রস্ততকৃত পণ্যের দাম কমেনি।
মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পণ্যটির দাম বড় আকারে বেড়ে গেলেও তা বর্তমানে অনেক সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছে। তা সত্ত্বেও একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীর নানা অজুহাতে দাম কমানোর ক্ষেত্রে রয়েছে অনীহা।
সূত্র জানায়, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে দেশীয় বাজারে ২ কেজি আটার প্যাকেট ৯০ টাকায় এবং ময়দা ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় পাওয়া যেত। কিন্তু যুদ্ধের এক মাসের মধ্যে দাম বেড়ে ১২০ টাকা ও ১৪০ টাকা ওঠে।
ব্যবসায়ীদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে গম ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যেও দাম দ্রুত বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ দায়ী। তবে এরপর বিশ্ববাজারে গমের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমলেও দেশীয় বাজারে আটা-ময়দা, রুটিসহ বেকারি সামগ্রীর দাম কমেনি, আগের যে দাম ছিল সে দামেই রয়েছে।
এদিকে গত দেড় বছর আগে দেশের পাইকারি বাজারে গমের দাম ছিল মণপ্রতি ৯০০ থেকে সর্বোচ্চ ১১০০ টাকা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে পুঁজি করে দেশে গমের পাইকারি দাম বেড়ে ১৯০০ থেকে সর্বোচ্চ ২৩০০ টাকায় উঠে যায়। তবে বর্তমানে দাম অনেকটা কমে ১৬০০ থেকে ২০০০ টাকার মধ্যে কেনাবেচা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে যে দাম কমার প্রভাব পুরোপুরিভাবে পড়েনি।
বিশ্বব্যাংকের পিঙ্কশিটের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালে বৈশ্বিক গমের গড় দাম ছিল টনপ্রতি ৩১৫ ডলার। ২০২২ সালে এসে গমের দাম বেড়ে ৪৩০ ডলারে পৌঁছে। একই বছরের এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে পণ্যটির দাম রেকর্ড ৪৯৩ ডলারে উঠে যায়। যদিও এরপর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানিতে রাশিয়া-ইউক্রেন চুক্তির কারণে বিশ্বব্যাপী গমের দাম কমতে শুরু করে। বিশ্বের মোট গম চাহিদার প্রায় ২৮ শতাংশ রাশিয়া-ইউক্রেন অঞ্চল থেকে সরবরাহ হওয়ায় বিশ্ববাজার অস্থির হলেও বর্তমানে স্থিতিশীলতার দিকে ফিরছে।
প্রতিবেদনে চলতি বছরের এপ্রিলে গমের টনপ্রতি গড় দাম ছিল ৩৭৮ ডলার। মে মাসে দাম আরো কমে ৩৬৭ ডলার এবং জুনে সেটি আরো কমে ৩৪৫ ডলারে নেমে এসেছে।
এদিকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য হচ্ছে গম। বছরে ৭০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় ১০ থেকে ১২ লাখ টন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের সহকারী মহাব্যবস্থাপক প্রদীপ করণ বলেন, বিশ্ববাজারের দাম কমার প্রভাব দেশীয় গমের বাজারে কিছুটা কমে এসেছে। তবে বর্তমানে বাজারে যেসব গম রয়েছে, তা প্রায় ৩ মাস আগের কেনা। এ অবস্থায় চাইলেও বিশ্ববাজারের সাথে দেশীয় বাজারে দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে পাইকারি-খুচরা পর্য়ায়ে আটা-ময়দার দাম কমবে।
প্যাকেটজাত আটা-ময়দার সর্বোচ্চ খুচরামূল্য এখনও অপরিবর্তিত থাকার কথা জানান তিনি।
এদিকে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ‘র (টিসিবি) তথ্য বলছে, খোলা আটার দাম গত বছরের তুলনায় ১৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ কমে ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছরের একই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫৫ টাকায়।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জের গম ব্যবসায়ী আর এম ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আলমগীর পারভেজ বলেন, বিশ্ববাজারে গমের দাম কয়েক মাসের ব্যবধানে যুদ্ধের আগের অবস্থার চেয়েও কম। কিন্তু দেশীয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সেই পরিমাণে দাম কমায়নি। তবে গমের দাম সামান্য কমলেও আটা-ময়দার দাম একদমও কমেনি।
তিনি বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বরতদের কঠোর মনিটরিং না থাকায় প্রভাব পড়ছে না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার ভাই-বন্ধু বেকারি ফুডের বিক্রেতা এমরান হোসেন বলেন, বেকারি পণ্য বিক্রিতে আগের মতো লাভ করা যায় না। আটা- ময়দার দাম আগে কম থাকায় রুটি, কেক, বিস্কুটসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রিতে ভালো লাভ হতো। কিন্তু গত দেড় বছরে আটা-ময়দার দাম বেড়ে যাওয়ায়, কাস্টমারেরা এ পণ্য আগের মতো কিনছেন না।
মিরপুর-১ নম্বরে আরিয়ান হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের স্বত্ত্বাধিকারী এনাম হোসেন বলেন, বর্তমানে হোটেল ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। আটা-ময়দার দাম বাড়তি, কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ অন্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় হোটেল ব্যবসায় হিমসিম খেতে হচ্ছে। তবে হোটেল বর্তমানে তান্দর রুটি, নানরুটি (প্রতি পিস ১৫ থেকে ২৫ টাকা) সিঙ্গাড়া (প্রতি পিস ১০ টাকা থেকে ২০ টাকা) , যা দুই বছর আগে বিক্রি হতো অর্ধেক দামে। জিলাপি প্রতিকেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা, যা আগে বিক্রি হতো ১২০ টাকায়। এছাড়া অন্য আইটেমের দামও বেড়েছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহকারী ব্যবস্থপক (হিসাব বিভাগ) তসলিম শাহরিয়ার বলেন, বিশ্ববাজারে গমের বুকিং রেট কমে যাওয়ায় দেশীয় বাজারেও আমরা আটা-ময়দার দাম কমিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, পাইকারিতে আমরা বর্তমানে ৫০ কেজির প্রতিবস্তা আটা ২,০০০ টাকা এবং ময়দা ২,৭০০ টাকায় প্রতিকেজি ৫৪ টাকায় বিক্রি করছি। আর গত বছরের মে মাস থেকে আটা ২,৭০০ টাকা এবং ময়দা ৩,৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। আর পাইকারিতে দাম কমানোর পরেও খুচরা পর্যায়ে দাম না কমাটা দুঃখজনক।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, যখনই বিশ্ববাজারে দাম বাড়ে, দেশের সব আইন এবং সংস্থাকে তোয়াক্কা না করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয় আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার যখন কমে যায়, তখন আগের পণ্য, নানা খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দাঁড় করায়। তবে কঠোরভাবে পণ্যের দামের বিষয়টি মনিটরিং হলে অনেকটা কমতো বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর সময় খাদ্যপণ্যের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার যে রেকর্ড হয়েছিল তা গত মার্চে এসে সাড়ে ২০ শতাংশ কমেছে। খাদ্যপণ্যের দাম গত ফেব্রুয়ারির ১২৯ দশমিক ৭ পয়েন্ট থেকে কমে মার্চ মাসে ১২৬ দশমিক ৯ পয়েন্ট হয়েছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে এটি সবচেয়ে কম পয়েন্ট।
এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো তোরেরো মতে, বিশ্ববাজারে যখন পণ্যের দাম কমে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বেশি থাকে, তখন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়।
সংস্থাটি আরো জানায়, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকা আমদানি কমার পাশাপাশি কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের খাদ্যশস্য সরবরাহ চুক্তির মেয়াদ বাড়ানোয় বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে। মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, গমের দাম কমেছে ৭.১ শতাংশ, ভুট্টার দাম কমেছে ৪.৬ শতাংশ, চালের দাম কমেছে ৩.২ শতাংশ ও ভোজ্যতেলের দাম কমেছে ৩ শতাংশ।
এদিকে ২০২২ সালের মার্চের তুলনায় খাদ্যপণ্যের দাম ৪৭.৭ শতাংশ কমেছে। আর চিনির দাম বেড়েছে ১.৫০ শতাংশ।