ভারতীয় মিডিয়া কেন মৌলবাদী বাংলাদেশ দেখাতে চায়?

প্রকাশিত: ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১২, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকার বাংলাদেশে হাসিনার পতন এবং প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতায় আরোহণকে কয়েকটি কারণে মেনে নিতে পারেনি। নরেন্দ্র মোদি হিসাব কষেছেন হাসিনার পতনে ভারতের জাতীয় স্বার্থ ভীষণ ক্ষতির মুখে পড়েছে। হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে ভারত যে বেশুমার বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়েছে তা আগামীতে ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের ওপর দীর্ঘ ১৬ বছর যাবৎ ভারত যে কূটনৈতিক খবরদারি চালাত সেটারও অবসান হতে চলেছে। ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা মনে করেছিলেন হাসিনার পতনের পর শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশও অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে। আর সেই সংকট উত্তরণে নবগঠিত ইউনূস সরকার ভারতের কাছে সাহায্য চাইবে। কিন্তু ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আর্থিক ও রাজনৈতিক সাহায্য-সমর্থন লাভ করায় বাংলাদেশকে আর ভারতের মুখাপেক্ষী হতে হয়নি। ড. ইউনূস রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই তিনি বিশ্ব নেতাদের প্রশংসা, অভিনন্দন ও সমর্থন লাভ করতে থাকেন। ভারতের চোখ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখবার দীর্ঘ ১৬ বছরের অঘোষিত পশ্চিমা রীতি-প্রথা কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ ভারতের সাথে স্বাধীন দেশের মতো সমমর্যাদার ভিত্তিতে কথা বলা শুরু করে। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার কর্তৃক ভারতকে পরোয়া না করার নীতি অবলম্বনে নরেন্দ্র মোদির কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে নরেন্দ্র মোদি তার দেশের বিরোধী দলগুলোর কাছে নিজের অহমিকা-বাহাদুরি দেখাতে পারতেন। বাংলাদেশে চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে রাখার কূটনৈতিক সাফল্যের মিথ্যা কৃতিত্ব জাহির করতেন। এছাড়া হাসিনা প্রীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে দেশে সংখ্যালঘু ভোট কুড়ানোর মূল কাজটা সেরে ফেলতেন। কিন্তু হাসিনার অকস্মাৎ পতনে মোদির রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের সেসব যাবতীয় গলাবাজিতে ছেদ পড়ে যায়। হাসিনা আমলে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিয়োগান্ত ঘটনার সাথে ভারতের সংশ্লিষ্টতার জোর গুঞ্জন শোনা যায়। বাংলাদেশি নাগরিকদের গুম খুনের সাথেও ভারতের জড়িত থাকার খবর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যেই হাসিনা আমলে সংঘটিত বিভিন্ন গুম-খুন সংক্রান্ত ঘটনার রিপোর্ট তদন্ত কমিশন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের কাছে পেশ করেছে। এছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও এ নিয়ে দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এসব অপকর্মে হাসিনার সহযোগী হিসেবে যদি নরেন্দ্র মোদি ও তার বিজেপি সরকারের সংশ্লিষ্টতা উন্মোচিত হয় তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারত ভীষণ নাজুক অবস্থায় পড়ে যাবে।

সুতরাং এসব কারণে বাংলাদেশের ড. ইউনূস সরকার ভারতীয় কর্তাব্যক্তিদের কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। তারা প্রতিকূল অবস্থা থেকে ভারতকে উত্তরণের জন্য প্রফেসর ইউনূস সরকার তথা বাংলাদেশকে চাপে ফেলার নানামুখী কৌশল নিয়েছে। সেসবের মধ্যে দৃশ্যমান কৌশল হলো হাসিনাকে দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে প্রয়োজনমাফিক উৎপাত করানো, সংখ্যালঘু কার্ড খেলা, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের জিগির তোলা এবং বিপ্লব পরবর্তীকালে উদ্ভূত বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিকে ব্যবহার করা। আর এসব কৌশল বাস্তবায়নের অন্যতম মাধ্যম হলো ভারতীয় মিডিয়া। এ কারণেই হাসিনার পতনের পরক্ষণেই ভারতীয় প্রচার মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশ বিরোধী প্রচণ্ড প্রোপাগান্ডা। তাদের অস্থির-অসংলগ্ন প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হয় তারা বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে গণ্য করে না। তাদের প্রচারিত-প্রকাশিত তথ্য-বয়ান দ্বারা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে খাটো করার অবিরাম চেষ্টা চলতে থাকে। যেসবের সারকথায় বোঝানোর চেষ্টা করা হয় ভারত দয়া না করলে বাংলাদেশের খবর আছে, ভারত ছাড়া গতি নাই, হাসিনার ফ্যাসিবাদ বৈধ ছিল, হাসিনাকে পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করো ইত্যাদি। এভাবে ভারতীয় মিডিয়ায় চলে এক অদ্ভুত সাংবাদিকতা। রিপোর্টিং উধাও করে দিয়ে মতামত প্রতিষ্ঠার কারবার চলে। যে কথা সরকারি ভাষ্যে সরাসরি মুখ দিয়ে বলা যায় না তা অন্যের মাধ্যমে মিডিয়াকে দিয়ে প্রকাশের কৌশল নেওয়া হয়।

নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারের পরিচালিত মিডিয়াগুলোকে বলা হয় গোদি মিডিয়া। ভারতীয় স্বার্থের দেখভালকারী বিভিন্ন চিন্তন প্রতিষ্ঠানের (ঞযরহশ ঞধহশ) সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের লেখাগুলোও প্রকাশিত হতে থাকে মিডিয়ায়। এভাবে শক্তিশালী ভারতীয় গণমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ওপর। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর ভারতীয় শাখা অফিস পরিচালিত হয় ভারতীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাংবাদিকদের দ্বারা। আমেরিকান-ইউরোপীয়দের তুলনায় তাদের অন্তত ১০ গুণ কম বেতন-ভাতায় নিয়োগ দেওয়া যায়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিযুক্ত এসব ভারতীয়রা তাদের দেশের প্রতি অন্ধভক্তি থাকায় সহসাই বাংলাদেশবিরোধী নেতিবাচক খবর পরিবেশনায় যুক্ত হয়ে পড়েন। এতে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা গ্রহণযোগ্যতা পায়। কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নিউজ ওয়েবসাইট বাংলা ভার্সনে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। তবে সেসবের ওপর কলকাতা ও দিল্লির সাংবাদিক-কর্তাব্যক্তিদের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান। এ কারণে এসব মিডিয়াতেও বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর প্রকাশ করা হয় এবং হাসিনাকে রাজনীতিতে ফেরানোর পরোক্ষ চেষ্টা চালানো হয়। এজন্য এসব আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বাংলা সংস্করণের পৃষ্ঠা একপ্রকার ভাড়ার বিনিময়ে সংবাদ, মতামত, সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যেন বাংলাদেশবিরোধী এক জোরদার বয়ান তৈরি হয়।
৭ মার্চ ২০২৫ ঢাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীরের আনুমানিক দেড়শত কর্মী ঝটিকা মিছিল করে। তবে পুলিশের তৎপরতায় মিছিলটি দ্রুতই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ভারতীয় মিডিয়ায় এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিষয়টিকে ফলাও করে প্রচার করা হয়। যেমন এ নিয়ে ৮ মার্চ ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা দ্য প্রিন্ট একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যার শিরোনাম হলো: ইধহহবফ ঐরুনঁঃ ঞধযযৎরৎ ৎধষষরবং ভড়ৎ ওংষধসরপ পধষরঢ়যধঃব রহ ইধহমষধফবংয. ডযড় ঃযবু ধৎব. দেবদত্ত চক্রবর্তীর লেখা ওই নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, কয়েক হাজার হিজবুত তাহরীর কর্মীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ ঘটনায় অনেকে নাকি বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভের জন্য ইউনূস সরকারের সমালোচনা করছেন। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কয়েকজন কথিত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং ইউনূস সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়। বলা হয়, ‘বর্তমান বাংলাদেশের অবস্থা ১৯৭১ সালের চেয়েও খারাপ আকার ধারণ করেছে, ইউনূস সরকার তাদের ক্ষমতাকাল দীর্ঘায়িত করার জন্য এসব জঙ্গিদের ব্যবহার করছেন, বাংলাদেশের কষ্টার্জিত ধর্মনিরপেক্ষতা ধ্বংস করে দিচ্ছেন ইউনূস। সবশেষে উপদেশ দিয়ে বলা হয়, অনির্বাচিত অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দীর্ঘ কাল ধরে ক্ষমতায় থাকলে সহসাই উগ্রবাদের উত্থান ঘটে। জাতীয় নির্বাচন যত দেরিতে হবে নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর ততই উত্থান ঘটবে এবং তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে ততই প্রভাবিত করবে।’ অর্থাৎ দ্য প্রিন্ট বলতে চাইছে বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে এসব উপদ্রবের অবসান ঘটবে।

দ্য প্রিন্টের ওই প্রতিবেদনে হিজবুত তাহরীরের দীর্ঘ পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে একটি অখ্যাত-অপরিচিত নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রতি মানুষকে অহেতুক কৌতূহলী করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মানুষ এ ক্ষুদ্রাকৃতির নিষিদ্ধ সংগঠন সম্পর্কে আদৌ বিচলিত নয়। এদের দমনের বিষয়ে ডক্টর ইউনূস সরকারের প্রতি জনগণ যথেষ্ট আস্থা রাখেন। জনগণ বরং হিজবুত তাহরীরের এই ঝটিকা মিছিলকে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা হিসেবে সন্দেহ করছে। কেননা তারা প্রদর্শন করেছে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়া রঙের ব্যানার-ফেস্টুন।

দ্য প্রিন্টসহ ভারতের অপরাপর শীর্ষস্থানীয় মূলধারার গণমাধ্যম বাংলাদেশ বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন নেতিবাচক খবরাদি ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদ উত্থানের সম্ভাবনা নিয়ে তাদের উদ্বিগ্ন হতে দেখা যায়। তাদের বেশকিছু প্রতিবেদন ও নিবন্ধে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ইসলামী উগ্রবাদীদের নেতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ২৭১টি ভুয়া তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এ পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক তথ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতন কিংবা ইসলামী মৌলবাদের উত্থান বিষয়ে খবর পরিবেশন করে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কীভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুলসী গ্যাবার্ড, ক্যাশ প্যাটেল প্রমুখ ব্যক্তিদের কান ভারি করা যায় সেই চেষ্টায় রয়েছে ভারতীয় মিডিয়া। ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ২০ বছর ভারত বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী দেশ ছিল। বর্তমানে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ যুদ্ধ একপ্রকার বন্ধ হওয়ায় আর পূর্বেকার মতো মার্কিন-ভারত সম্পর্কের আবেদন নেই। কিন্তু ভারত সেই সুখস্মৃতিটুকু ভুলতে পারছে না। সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ভারত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছিল। এখন সেই অবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনতে জঙ্গিবাদের জিগির তুলে মার্কিনি ও ইউরোপীয়দের কান ভারি করতে চায় যাতে তারা নরেন্দ্র মোদির পিঠ চাপড়ে দেন। এমন বাসনা থেকেই ভারতীয় মিডিয়া বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করতে চায়।