ভুয়া এতিম দেখিয়ে বরাদ্দ আত্মসাৎ

প্রকাশিত: ৩:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০২৪

ঝালকাঠি প্রতিনিধি:

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে ১৩টি বেসরকারি এতিমখানার নিবন্ধন রয়েছে। এসব এতিমখানার আবাসিক বাসিন্দা ৫৪৩টি শিশু। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, তাদের নামে বরাদ্দ হাতিয়ে নিতে প্রায় সব এতিমখানার দায়িত্বশীল ব্যক্তি ভুয়া নাম তালিকাভুক্ত করেন। পরে তাদের নামে আসা টাকা হাতিয়ে নেন। এতে সহায়তা করেন উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। যদিও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।

রোববার সরেজমিন উপজেলার তালতলা বাহাদুরপুর হোসাইনিয়া এতিমখানায় ১০-১৫ শিশুকে বসবাস করতে দেখা গেছে। অথচ চলতি অর্থবছরে সেখানে ৩০ শিশুর জন্য বার্ষিক ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাওলানা কামাল হোসেনের ভাষ্য, তাঁর প্রতিষ্ঠানে এতিম-দুস্থ মিলিয়ে ৩০ জন আছে। তবে সেদিন সবাই উপস্থিত ছিল না বলে দাবি করেন।
উপজেলার রানাপাশা ইউনিয়নের মধ্য ভেরনবাড়ীয়া তালুকদারবাড়ি আয়শা খাতুন এতিমখানায় কোনো এতিমই নেই। প্রতিষ্ঠানটিতে নির্মাণ করা সরকারি সাইক্লোন শেল্টারের সাইনবোর্ড আছে। এতিম নয়, এমন চার শিক্ষার্থী আছে এতিমখানাটিতে। এর পরিচালক হামিদ মোল্লা বলেন, বাচ্চারা ছুটিতে বাড়িতে গেছে। পরে আসবে।

সব এতিমখানায় একই চিত্র। সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপজেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, সরকার প্রতিটি এতিম শিশুর ভরণপোষণ ও পড়ালেখার জন্য মাসে ২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। বছরের হিসাবে জনপ্রতি তা ২৪ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। উপজেলার ১৩ এতিমখানার নিবাসী ৫৪৩টি শিশুর জন্য প্রতি মাসে ক্যাপিটেশন গ্রান্ড (নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারি এতিমখানায় শিশুদের প্রতিপালনের জন্য সরকারি আর্থিক সহায়তা) ও মজুরি বাবদ মোট ব্যয় ১০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা।
উপজেলার তিমিরকাঠী হোসাইনিয়া এতিমখানায় ২২ জন, মধ্য ভেরনবাড়ীয়া তালুকদারবাড়ি আয়শা খাতুন এবতেদায়ি মাদ্রাসা ও এতিমখানায় ৩০ জন, কাঠীপাড়া এছহাকিয়া এতিমখানায় ২৩ জন, হদুয়া বৈশাখিয়া হোসাইনিয়া এতিমখানায় ৯৮ জন, তালতলা বাহাদুরপুর হোসাইনিয়া এতিমখানায় ৩০ জন, দারুল ইসলাম এতিমখানায় ১৫ জন, মদিনাতুল উলুম এতিমখানায় ৪৪ জন, আছিয়া খাতুন এতিমখানায় ৫৫ জন, দরবার শরিফ এতিমখানায় ৭৫ জন, রায়াপুর জামিইয়া এছাকিয়া আরাবিয়া এতিমখানায় ৬৫ জন, কায়েদাবাদ সিদ্দিকীয়া ইয়াতিমখানা ও প্রবীণ নিবাসে ৫২ জন, কাপড়কাঠী আয়শা বেগম এতিমখানায় ১২ জন ও শাহি মদিনা এতিমখানায় ২২ জনের নামে প্রতিমাসে বরাদ্দ আসে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট পেতে এতিম ছাত্রদের তালিকা তৈরি, অর্থ গ্রহণ ও বণ্টনে সরকারি কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। সরেজমিন পরিদর্শনও হয় না। স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে বানোয়াট উপকারভোগীর তালিকা তৈরি করে এতিমের নামে আসা বরাদ্দ ভুয়া বিল ভাউচার দেখিয়ে আত্মসাৎ চলছে। এতে জড়িত উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাসহ কার্যালয়ের অন্যান্য কর্মকর্তা ও এতিমখানার পরিচালক।

তালিকাভুক্ত এতিমখানাগুলোতে সাইনবোর্ড ছাড়া শিক্ষার্থীদের তেমন উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো ভর্তি রেজিস্টার, পাঠদানের ব্যবস্থা। তেমন কোনো শিক্ষা উপকরণও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বাবুর্চি ও মানসম্মত শৌচাগারেরও দেখা মেলেনি। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই গত আট বছরে অল্পসংখ্যক শিশুই আবাসিকে থেকেছে। যে কয়েকজনকে পাওয়া গেছে, তাদের অনেকেই পাশের মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যৌথভাবে পড়ে। তাদের বাবা-মাও আছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক শিশুকেই পাওয়া গেছে, যারা এতিম নয়। তবে তাদের সবাই দরিদ্র পরিবারের।

উপজেলার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান মোল্লারহাট ইউনিয়নের হদুয়া বৈশাখিয়া হোসাইনিয়া এতিমখানা। প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯৮ জন এতিম শিশুর বিপরীতে ১১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। কিন্তু ওই প্রতিষ্ঠানে ১৫-২০ জনের বেশি এতিম শিশুর বসবাসের সত্যতা মেলেনি। তবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মাওলানা হোসানের দাবি, সেখানে ৫৮ জন এতিম শিশু থাকে।

একই এলাকায় দরবার শরিফ এতিমখানা হদুয়া নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম অধিদপ্তরের তালিকায় রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থী দেখানো হয়েছে ৭৫ জন। অথচ এ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, এতিমখানার শিক্ষার্থীর নামে বরাদ্দ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়। বরাদ্দ কমবেশি করার সুযোগ তাদের হাতে নেই। তাঁর দাবি, প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা ঢাকায় তদবির করে এসব বরাদ্দ নিয়ে আসেন। ভুয়া বরাদ্দ বন্ধের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন কিনা, এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলামের কাছে অবশ্য এতিমখানার বরাদ্দ আত্মসাতের কোনো তথ্য নেই। তিনি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।