বগুড়া প্রতিনিধিঃ
তথ্য গোপনের মাধ্যমে ভুয়া অভিজ্ঞতার সনদ ব্যবহার করে সরকারি চাকরি করেছেন তিনি। পাশাপাশি মাত্র ১০ বছরে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি সুবিধা নিয়ে সরকারের প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনটি করেছেন বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠ সরকারি আজিজুল হক কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক শাহজাহান আলী।
জানা গেছে, ১৬তম বিসিএসের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের ১০ আগস্ট প্রভাষক পদে যোগদান করেন তিনি। এই পদে যোগদানের আগে একই বছরের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক প্রকাশিত সংযুক্ত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সুযোগ নিতে ১০ শতাংশ কোটায় সহকারী অধ্যাপক (গণিত) পদের জন্য আবেদন করেন। আবেদনে বর্ণিত প্রথম শ্রেণির সম্মানসহ দ্বিতীয় শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং যেকোনো ডিগ্রি কলেজ থেকে ছয় বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ করে ১৯৯৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সহকারী অধ্যাপক পদে সরাসরি নিয়োগ পান।
তার এক সহপাঠী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শাহজাহান ঢাকার মতিঝিলের টিঅ্যান্ডটি কলেজে চাকরি করেছেন। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার সনদ সম্ভবত ওই কলেজ থেকেই নিয়েছেন। যা সম্পূর্ণ ভূয়া। কারণ তার অভিজ্ঞতা পুরো ৬ বছর পূর্ণ হয়নি। ফলে সরকারিবিধি মোতাবেক এই সনদের কোনো বৈধতা নেই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অধ্যাপক শাহজাহান আলী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯০ সালের ১৩ মে গণিত বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাস্টার্স পাস করেন। তার রোল নং ১৭৩। তিনি মীর মোশাররফ হোসেন হলের শিক্ষার্থী ছিলেন। পিএসসির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের তারিখ থেকে তার মাস্টার্স পাসের তারিখ পর্যন্ত সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ৫ বছর ৮ মাস ৩ দিন। একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর চাকরির আবেদন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ৫-৬ মাস বা ১-২ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। অথচ তিনি ৬ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার যে সনদ দিয়েছেন তাতে প্রায় ৪ মাসের ঘাটতি দেখা যায়।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলো অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি পাস। তিন বছরের অনার্স কোর্সের ক্ষেত্রে শর্তটি বাধ্যতামূলক। অথচ তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি গ্রহণ করেছেন।
অধ্যাপক শাহজাহান আলী ১৯৯৮ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ লাভের পর মাত্র ৬ বছরের মাথায় সহযোগী অধ্যাপক এবং মোট ১০ বছর মেয়াদে চাকরি করার পরই আলাদিনের যাদুর চেরাগের ক্ষমতাবলে ২০০৮ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি তৃতীয় গ্রেডের একজন কর্মকর্তা। অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক স্বয়ং চতুর্থ গ্রেডের কর্মকর্তা।
একটি সূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক শাহজাহান আলীর কর্মজীবন ২৮ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এবং তিনি ২০২৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি অবসর ছুটিতে যাবেন। অথচ এখনো তার চাকরি স্থায়ীকরণ হয়নি। তিনি একাধিকবার চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও তা অনুমোদন পায়নি। সর্বশেষ গত ২০ আগস্ট তিনি একই কলেজের কয়েকজন অধ্যাপকের সঙ্গে চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য আবেদন করেন। গত ২৮ নভেম্বর ২০২৩ তাদের কয়েকজনের চাকরি স্থায়ীকরণের গেজেট জারি হলেও তাতে অধ্যাপক শাহজাহান আলীর নাম নেই। একজন ক্যাডার কর্মকর্তার জন্য যেটি আবশ্যক।
এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, অধ্যাপক শাহজাহান আলীর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে উপস্থাপন করা নথিতে (পিডিএস) চাকরি স্থায়ীকরণের কলামে একটি স্মারক নম্বর ও তারিখ দেওয়া আছে (৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৮)। এই তথ্যটিও ভূয়া।
অধ্যাপক শাহজাহান আলী বগুড়া আজিজুল হক কলেজে কর্মরত থাকা অবস্থায় সিনিয়র বিসিএস ব্যাচের নারী সহকর্মীর সঙ্গে অসাদাচরণের অভিযোগে একাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২২ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে ওএসডি হন। বর্তমানে তিনি অধিদপ্তরে সংযুক্ত রয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে ভূয়া অভিজ্ঞতার সনদে চাকরি গ্রহণ, বিপুল অংকের টাকার দুর্নীতিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগ উত্থাপিত হলেও রহস্যজনক কারণে কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো আমলে নেয়নি।
একজন ব্যক্তির পরীক্ষার পাসের তারিখ থেকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির তারিখই যেখানে ৬ বছর পূর্ণ হয়নি সেখানে ৬ বছরের অভিজ্ঞতার বিষয়টি সম্পূর্ণ হাস্যকর ও চরম জালিয়াতির কাণ্ড বলে মন্তব্য করেছেন তার একাধিক ব্যাচমেট বন্ধু। তারা আরও বলেন, একই ব্যাচে যোগদান করে আমরা ২০২২-২৩ সালে অধ্যাপক হলাম। আর উনি ভূয়া সনদ দেখিয়ে ১৩-১৪ বছর আগে (২০০৮) অধ্যাপক হয়ে সরকারের প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।
তারা বলেন, অধ্যাপক শাহজাহান আলী স্বাভাবিকভাবে পদোন্নতি পেলে আমাদের মতোই ১১ বছরে সহকারী অধ্যাপক, চাকরির ১৯ বছরে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২৭ বছরে অধ্যাপক হতেন। তাহলে তার মূল বেতন দাঁড়াতো ৭১ হাজার ২০০ টাকা। অথচ ১০ পারসেন্ট কোটায় নিয়োগ পাওয়ার কারণে বর্ধিত বেতন স্কেল তিনি বহু আগে থেকেই পেয়ে আসছেন। এই নিয়োগের কারণে তিনি সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদে বেতন, বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতা গ্রহণে অতিরিক্ত প্রায় কোটি টাকার সুবিধা নিয়েছেন।
১০ পারসেন্ট কোটায় নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬ বছরের অভিজ্ঞতা সনদ কোন প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছেন জানতে চাইলে অধ্যাপক শাহজাহান আলী বলেন, এটি আমি পিএসসিতে জমা দিয়েছি। এটা অন্য কারো কাছে বলতে বাধ্য নই।
একইসঙ্গে তিনি দাবি করেন, তার চাকরি ১৯৯৮ সালেই স্থায়ীকরণ হয়েছে। এরপর তিনি স্থায়ীকরণের কোনো আবেদন করেননি।
পরীক্ষায় পাস করা থেকে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পর্যন্ত ৬ বছরের কম সময় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি পাস করার আগেই এই চাকরির আবেদন করেছিলাম।