শনিবারে স্কুল খোলা: আন্দোলন করলে বাতিল হতে পারে এমপিও
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
শিখন ঘাটতি ঠেকাতে সাপ্তাহিক ছুটির একদিন শনিবার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার সরকারি নির্দেশ মানতে চান না কিছু কিছু শিক্ষক। তাই প্রতিবাদ জানিয়ে আগামী শনিবার (১১ মে) সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি পালন করার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। ‘বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির’ ব্যানারে এই কর্মবিরতির পর আরও কঠোর কর্মসূচিরও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে প্রতি শনিবারই কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি।
তবে এই কর্মসূচি পালন করবে না অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অন্তত রাজধানীর উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজসহ নামিদামি কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করার কোনও সুযোগ নেই।
শিক্ষা প্রশাসন বলছে, সরকারি আদেশ না মানলে এই ইস্যুতে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলন করা শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে এমপিও স্থগিত বা বাতিল করা হবে। শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দিয়ে আন্দোলনে নামলে প্রতিষ্ঠান প্রধানেরও এমপিও স্থগিত বা বাতিল হতে পারে।
আগামী শনিবার সারা দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই কর্মবিরতি কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক মো. নূরে আলম বিপ্লব। সংগঠনের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াছিন গণমাধ্যমের কাছে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেন।
মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, ‘আগামী শনিবার (১১ মে) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে। কিন্তু এক ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবো। সরকার যদি আমাদের বিষয়টি আমলে না নেয় তাহলে প্রতি শনিবার পুরো দিন কর্মবিরতি পালন করা হবে। আর সরকার যদি বিষয়টি সুরাহা না করে তাহলে পরবর্তী শনিবারগুলোয় পুরোপুরি কর্মবিরতি পালন করবো। তবে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবো।’
বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতির প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সরকারের এমন একতরফা সিদ্ধান্তে (শনিবার খোলা রেখে শ্রেণি পাঠদান) শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকরা সংক্ষুব্ধ। নির্ধারিত ও সাপ্তাহিক ছুটিতে শিক্ষার্থীরা পাঠ সংশ্লিষ্ট ‘বাড়ির কাজ’ সম্পন্ন করতে পারেন। অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চিকিৎসা নেওয়া, আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ানো, আচার-অনুষ্ঠান এবং বিশ্রামসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। এক দিনের ছুটিতে যাবতীয় কাজ ও সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
তবে অভিভাবকরা বলছেন ভিন্ন কথা। শনিবার স্কুল খোলার রাখার পক্ষে মত দিয়ে অভিভাবকরা বলেন, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে শিক্ষকরা শনিবার কর্মবিরতি পালন করতে চাচ্ছেন। এটা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। কারণ করোনা মহামারি থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। অথচ শিক্ষকরা নিজেদের স্বার্থে আন্দোলন করতে চাচ্ছে, যা নীতিমালা বিরোধী। যেসব শিক্ষক আন্দোলন করবেন তাদের এমপিও বাতিল করা প্রয়োজন।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ অভিভাবক ফোরামের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার কারণে এমনিতেই শিখন ঘাটতিতে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া শীত, গরম ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ছুটি দিতে হয়। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ঠিকমতো সম্পন্ন করতে হলে বেশি সময় প্রয়োজন। সরকার সে চিন্তা-ভাবনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শনিবার খোলা রেখে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা জরুরি। প্রয়োজনে যেকোনও দিন হতে পারে, শুক্রবার ক্লাস করে হলেও সিলেবাস শেষ করতে হবে। আবহাওয়া ভালো থাকলে শনিবারে ক্লাস করতে শিক্ষকদের সমস্যা কোথায়?’
মনিপুর স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘বাচ্চাদের জন্য ক্লাস প্রয়োজন। মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েই করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে বিদ্যালয় বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই শনিবারে ক্লাস নিতে পারে। করোনাকালীন সময় থেকে ছাত্ররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখন আবহাওয়া ভালো আছে, এখন তো ক্লাস নিতেই পারেন শিক্ষকরা।’
রাজধানীর কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ্ বলেন, ‘শিক্ষক সমিতির বিপক্ষে যেতে পারি না। আবার কোনোভাবেই সরকারের নির্দেশ অমান্য করা যাবে না। আমার মনে হয়, কত দিন শনিবার খোলা রাখা প্রয়োজন তা নিশ্চিত হতে পারলে সব শিক্ষকই হয়তো শনিবারের ক্লাস করতে সম্মত হবে।’
রাজধানীর উদয়ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জোহুরা বেগম বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি কমাতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এই অবস্থায় শনিবার ক্লাস চললে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। তাই আমরা শনিবার কর্মবিরতিতে যাবো না। শিক্ষকতা শুধুই চাকরি নয়, আমাদের একটি দায়িত্ব রয়েছে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমার তো মনে হয় শিক্ষকদেরই এটি বোঝা উচিত। শিখন ঘাটতির দায় তো তাদের ওপরই বর্তায়। অভিযোগ ওঠে শিক্ষকরা ঠিকমতো পড়ান না, কোচিং করান। শিখন ঘাটতির দায়টা শিক্ষকদের ওপরই আসে। তাদের নিজেদেরই উচিত শনিবারে ক্লাস করে এই দায় থেকে মুক্তি পাওয়া। এটি তাদের দায়মুক্তির একটি সুযোগ। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ায় শিক্ষকরা, মন্ত্রণালয় তো পড়ায় না, তাই দায়মুক্তির জন্য শিক্ষকদের উচিত এ বিষয়টি মেনে নেওয়া। কারণ সাপ্তাহিক ছুটি তো এককালীন বাতিল হচ্ছে না।’
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘সাময়িক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। শিক্ষার্থীদের যে ঘাটতি হয়েছে, তা পূরণ করার জন্য শনিবারের ক্লাস ছাড়া আরও কর্মসূচি নেওয়া দরকার। যেসব বাচ্চা পিছিয়ে আছে তাদের জন্য ক্লাসের আগে বা পরে ক্লাস নিয়ে তাদের উন্নয়ন করা যেতে পারে।’
সরকারের এই সিদ্ধান্ত যারা মানবে না তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারকে কঠোর হতে হবে। শাস্তির আওতায় আনলে দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। যদি শাস্তির আওতায় না আনা যায় তাহলে মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেবে একটা শিক্ষকরা করবে আরেকটা। শিক্ষার্থীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমরা সব সময় আছি। নতুন কারিকুলামে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের কোনও বিকল্প নেই, তাই ক্লাস নিতেই হবে।’
বাতিল হতে পারে এমপিও- সরাসরি সরকারের আদেশের বিরুদ্ধে অযৌক্তিকভাবে আন্দোলন করলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এমপিও বাতিল হতে পারে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষতির মধ্যে রেখে শিক্ষকরা যদি আন্দোলন করেন তাহলে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেবে বাস্তবায়নকারী সংস্থা শিক্ষার তিন অধিদফতর। নীতিমালা অনুযায়ী এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এমপিও স্থগিত করা হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব অবহেলার কারণে এমপিও বাতিল হতে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল হয়নি। শিখন ঘাটতি পূরণে আপাতত যে কয়দিন শনিবার ক্লাস করানো দরকার সে কয়দিন ক্লাস করানো হবে। ফলে শিক্ষক না বুঝে আন্দোলন করলে তা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হবে। আর নতুন কারিকুলামের বিরোধিতায় অনেকেই শুরু থেকে লেগে আছে।’
যে কারণে শনিবার ক্লাস চালু রাখার সিদ্ধান্ত- নির্ধারিত ১৮৫ দিন শিখন কর্মদিবস কমে যাওয়ার কারণে রোজার সময় কয়েকটি শনিবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ করায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ধর্মীয় স্পর্শকাতর হিসেবে উপস্থাপন করায় পিছু হটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর তাপপ্রবাহের কারণে আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই পরিস্থিতিতে সিলেবাস সম্পন্ন করার তাগিদ থেকে অস্থায়ীভাবে সাপ্তাহিক ছুটির একদিন শনিবার শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কর্মবিরতির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ মাধ্যমিক সহকারী শিক্ষক সমিতি।