স্বশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থ রাজকোষে নিতে বিল পাস
বিএনপি-জাপার তীব্র বিরোধিতা
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
বিএনপির ওয়াকআউটসহ জাতীয় পার্টির তীব্র বিরোধিতার মধ্যে বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) সংসদে ‘স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যানশিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাসমূহের তহবিলের উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান বিল-২০২০’ বিল পাস হলো। সাম্প্রতিক সময়ে কোনও বিল পাসের ক্ষেত্রে এমন জোরালো বিরোধিতার নজির নেই। বিরোধিতাকারী সংসদ সদস্যরা বিলটিকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ হিসেবে নিজেদের দেওয়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলোও প্রত্যাহার করে নেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিলটি পাসের প্রস্তাব করলে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়। বিল পাসের আগমুহূর্তে সংসদে উপস্থিত বিএনপির তিন এমপি সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেন। বিলের বিরোধিতা করলেও জাতীয় পার্টির সদস্যরা অবশ্য ওয়াকআউট করেননি। তবে বিলটি স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ভোটে দিলে তারা ‘না’ ভোট দেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ‘হ্যাঁ’ জয়ী হয়।
স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যানশিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক কাজে লাগাতে এই বিল পাস করলো সরকার।
বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হওয়ার আগে বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো উত্থাপনের সময় এর বিরোধিতা করেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির সংসদ সদস্যরা।
বিল নিয়ে আলোচনার সময় একাধিক সংসদ সদস্য অর্থমন্ত্রীকে ‘ব্যবসায়ী’ হিসেবে আখ্যায়িত বলেন। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, তিনি বিশ্বের সেরা অর্থমন্ত্রীর খেতাব পেয়েছেন।
গত ১৫ জানুয়ারি বিলটি সংসদে উত্থাপনের পর পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিলটি মন্ত্রিসভার অনুমোদন পায়। ওই দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, রাষ্ট্রের স্বশাসিত সংস্থাগুলোর আর্থিক স্থিতির পরিমাণ বর্তমানে ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই টাকা বিভিন্ন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে আছে।
বিলে বলা হয়েছে, এসব সংস্থা চালাতে যে খরচ হয় এবং নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বছরে যে টাকা লাগে, তা তাদের নিজস্ব তহবিলে জমা রাখা হবে। এছাড়া আপদকালীন ব্যয় নির্বাহের জন্য পরিচালন ব্যয়ের আরও ২৫ শতাংশ অর্থ এসব সংস্থা সংরক্ষণ করতে পারবে। ওই সংস্থার কর্মীদের পেনশন বা প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাও তারা সংরক্ষণ করবে।
বিলটি উত্থাপনের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পাবলিক নন-ফাইন্যানশিয়াল করপোরেশনসহ অন্যান্য স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব আইন ও বিধি অনুযায়ী আয়-ব্যয় ও বছর শেষে তাদের হিসাব রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। ব্যাংকে রক্ষিত হিসাবসমূহের স্থিতি থেকে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমে আছে। এই অর্থ জনগণের কল্যাণ সাধনে ব্যবহার করা সমীচীন।
বিলের ওপর আলোচনায় বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, সরকার রাজস্ব থেকে কেন উন্নয়ন করতে পারে না? শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম কমে যাবে। টাকা ব্যাংকে আছে। সেই টাকা নিয়ে নিলে শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ব্যাংকের হাতে টাকা থাকবে না। সরকারের এখন চোখ গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের দিকে। শেয়ার বাজার লুট, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থা খারাপ প্রকল্পের নামে সীমাহীন লুটপাট হচ্ছে। কেন অর্থমন্ত্রী এদিকে নজর দিচ্ছেন না?
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, পুঁজিবাজারে ১০ হাজার ইনডেক্স উঠেছিল, তখন আজকের অর্থমন্ত্রী ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তখনই তিনি বলেছিলেন, ৪ হাজার হওয়ার কথা, কীভাবে ১০ হাজার হলো। উনি জানতেন না। ব্যাংকের মালিক সমিতির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রী বসেন। কীভাবে হয়? এটা নিরঙ্কুশ সংখ্যগরিষ্ঠের ক্ষমতা দেখাবেন না। পৃথিবীতে অনেক দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে। কদিন পরে আমার অ্যাকাউন্টের টাকা নিয়ে নেবে কিনা সেই ভয়ে আছি!
বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, এটা একটা কালো আইন। আইন করে সব টাকা তুলে নেবে। উন্নয়ন-অর্থ দরকার আছে। কিন্তু সামর্থ্য কতটুকু? এই টাকাগুলো ব্যাংকে জমা আছে। টাকা নেওয়া হলে ব্যাংকগুলো মারাত্মক বিশৃঙ্খলায় পড়বে।
জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বিলটি পাস হলে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে যাবে। রাজস্ব বোর্ড অটোমেশন করতে দিচ্ছে না। টাকা চুরি করছে। ট্যাক্স নিচ্ছেন না, নিচ্ছেন ঘুষ।
তিনি বলেন, টাকার মালিক জনগণ। জনগণের গচ্ছিত টাকা। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধার করুন। জনগণের পকেটে হাত দিয়ে ফেলেছেন। ব্যাংকিং খাত ভেঙে পড়েছে। সেদিকে নজর দিন। টাকা পাচার বন্ধ করুন।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, অর্থমন্ত্রী ব্যবসায়ী হলে যা হয় তাই হয়েছে। বাজেট করার সময় চিন্তা করে নাই, রাজস্ব ঘাটতি সম্পর্কে চিন্তা করে নাই ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি। আগের বছরের চেয়ে ৪৫ ভাগ বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ঠিক করেছিল। করেছে মাত্র ৭ শতাংশ। এনবিআরের ব্যর্থতার কারণে এই বিল সমর্থন করতে পারছি না।
জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বিলটিকে জনবিরোধী আইন, ডিসগাস্টিং আইন আখ্যায়িত করে বলেন, আইন পাস হলে সংসদের ইতিহাসে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটবে। স্বাধীন দেশে এ ধরনের আইন হতে পারে না।
জবাবে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল জাতীয় পার্টি ও বিএনপিকে দোষারোপ করে বলেন, বাংলাদেশ অন্য দেশের কাছে দৃষ্টান্ত। আপনারা বলছেন, ব্যাংক, শেয়ার বাজার—সব খালি করে ফেলেছি। আপনাদের সময় পুঁজিবাজার কী ছিল? আপনাদের সময় ইনডেক্স কী ছিল? এবার সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। অর্থনীতিতে ওঠা-নামা থাকে।
মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, পারসোনাল লেবেলে কথা বলবেন, এটা ঠিক নয়। আমিও অনেক কিছু বলতে পারি। সবার বিষয়েই আমি জানি।
দেশের অর্থনীতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একমাত্র রফতানি বাণিজ্য নেগেটিভ। এটা ছাড়া একটি খাতও নেই আমরা পিছিয়ে আছি।
বিলের বিরোধিতাকারী উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য এক। পিছিয়ে পড়ে থাকা মানুষকে মূল স্রোতে নিয়ে আসা। যত বড় ব্যবসায়ী তত বেশি ট্যাক্স দিচ্ছেন। আইন সেভাবেই সাজানো। সরকারের কোষাগারে অর্থ জমা না পড়লে শৃঙ্খলা আসবে না।
তিনি বলেন, বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। তবে যেভাবে সুনির্দিষ্ট করে সংখ্যা বলা হচ্ছে, সেটা মোটেও ঠিক নয়। ২০১০ সালের পর থেকে পুঁজিবাজার মোটামুটি স্থিতিশীল আছে। এই মুহূর্তে কতজন ব্যাংকার, কর্মকর্তা জেলে আছে জানা দরকার। যারা অন্যায় করেছে বিচারে নিয়ে যাবো।
পাস হওয়া বিলে ৬১টি প্রতিষ্ঠানের তালিদা দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো— জাতীয় কারিকুলাম এবং টেক্সটবুক বোর্ড, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল, দিনাজপুর উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), পল্লী উন্নয়ন একাডেমি-বগুড়া, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ ও পরীক্ষা ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বার্ক), জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সেরিকালচার বোর্ড, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ), বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা), বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি), বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন, বাংলাদেশ চা বোর্ড, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), চট্টগ্রাম ওয়াসা, ঢাকা ওয়াসা, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ রেগুলেটরি কমিশন।