জেলা প্রতিনিধি, বরগুনা
‘আমরা এই শীতে ভোরে আই (আসি), একদম সকালে। আমরা মাছ ভাইঙাই (ভেঙে) খাই। শীতে আমাদের ঝিক (কাঁপুনি) উইঠা গেছে, হের পরও আমরা এই মাছ ভাঙি। করমু কী? আমাগো পেডের ধান্ধা, পেডে আমাগো দেতে হইবে। এ কারণে আমাদেরতো কাজ করতেই হইবে। হাত বরফ হইয়া গেছে। কষ্ট কইরা টাকা নিমু, চাউল কিনমু, হেইয়ার পর খামু।’
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার আবাসনের বাসিন্দা ফরিদা বেগম। তিনি পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে টাইগার চিংড়ি বাছাইয়ের কাজ করেন।
শীত মৌসুমে সাগরে জেলেদের জালে প্রচুর পরিমাণে টাইগার চিংড়ি ধরা পড়ে। ঠান্ডা বরফে মিশ্রিত এসব চিংড়ি কেজি প্রতি ১০ টাকা পারিশ্রমিকে বাছাইয়ের কাজ করেন এ অঞ্চলের কয়েক হাজার নারী। তবে তীব্র শীতের মধ্যে কাজ করে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করাই কষ্টকর। নারীদের পাশাপাশি স্বল্প সংখ্যক পুরুষরাও কাজ করেন।
মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বাছাইয়ের কাজে কর্মসংস্থান তৈরি হওয়া নারীদের অনেকেই বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা। থাকেন সরকারি আবাসনে। বিকল্প কোনো কাজ না জানায় শীতের তীব্রতা সহ্য করেই মাছ বাছাইয়ের কাজ করেন তারা। তবে এই নারীদের দাবি- কাজের তুলানায় তাদের পারিশ্রমিক খুবই কম।
পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, দিনে ও রাতের বিভিন্ন সময়ে সাগর থেকে মাছ ধরে ঘাটে ফিরে আসে এক-একটি মাছ ধরার ট্রলার। তবে দিনের তুলনায় রাতেই বেশি ট্রলার ঘাটে আসে। এসব ট্রলার ঘাটে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সামুদ্রিক মাছ ঘাটে তোলেন শ্রমিকরা। শীতকালীন এ সময়ে প্রতিটি ট্রলারেই ধরা পরে প্রচুর পরিমাণ টাইগার চিংড়ি। ফলে প্রতিদিন এসব চিংড়ির মাথা আলাদা করাসহ বাছাই কাজে ভোররাত থেকে ব্যস্ত সময় পার করেন এখানকার নারীরা।
পাথরঘাটা আবাসন থেকে ভোররাতে মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে আসা সায়েরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফজরের আজানের সময় এখানে এসে শীতের মধ্যে মাছ ভাঙার কাজ করি। প্রতি কেজিতে ১০ টাকা পাই, তাতে আমাদের সংসার চলে না। সব কিছুর যে দাম, আমাদের যদি একটু বাড়িয়ে দেয়, তাহলে আমাদের উপকার হয়।
একই এলাকা থেকে কাজে আসা মেরি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এই শীতে ভোররাতে উঠে এসেছি। সংসারে পাঁচজন লোক, আমরা কী কাজ করে খাবো? এজন্য ঘাটে এসে মাছ বাছাইয়ের কাজ করি। এখান থেকে যে টাকা পাই তা দিয়ে বাজার করে ছেলেমেয়ে নিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকি।
একই পেশায় যুক্ত মো. কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবাসন থেকে ভোর ৫টার সময় এখানে এসেছি। আমাদের অন্য কোনো কাজ না থাকায় এই মাছ বাছাই করেই আয় করি। বরফের মধ্যে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, তারপরও কিছু করার নেই। আমাদের এ কাজই করতে হবে।
সাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে আসা একটি ট্রলারের জেলে মো. রফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ট্রলার যখন ভোররাতে ঘাটে আসে। তখন থেকেই এই নারীরা মাছ বাছাইয়ের কাজ শুরু করেন। এ কাজের মাধ্যমেই তাদের পেট ও সংসার চলে।
এ বিষয়ে পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের সহকারী বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রিপন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বছরের নভেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আমাদের অবতরণ কেন্দ্রগুলোতে চিংড়ির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে এখানে তিন থেকে চার হাজার নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণের প্রথম ধাপ এখানে সম্পন্ন করে এগুলো বিদেশে রপ্তানি করা হয়।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে-বিদেশে টাইগার চিংড়ির চাহিদা রয়েছে। অবরোধকালীন সময় সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার ফলে টাইগার চিংড়ির উৎপাদন বেড়েছে। নভেম্বর থেকে মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত সমুদ্রে এ মাছ বেশি পাওয়ায় বরগুনাতে প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার নারীর কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে এসব নারীদের জীবনমান উন্নয়নে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরিতেও আমরা কাজ করছি।