হারিসুল হকের কবিতায় প্রেম-ভালোবাসা আর আত্মসন্ধানের সৃজনশীল বিন্যাস
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
খুব কম কাব্যগ্রন্থই আছে যা পড়ার সাথে সাথেই দাগ কাটে মনে। পড়া থামিয়ে ভাবতে হয়। অগ্রজ কবি হারিসুল হকের ‘আরাধ্য কষ্টের মহিমায়’ এমনই এক কাব্যগ্রন্থ। তাঁর এ কাব্যগ্রন্থে বিষয় হিসেবে যেমন এসেছে প্রেম, বিরহ, দ্রোহ, তেমনই এসেছে যাপিত জীবন, মান-অভিমান, আশা-নিরাশা, স্বপ্ন আর হাহাকারের আখ্যান।
ভাষার ভেতরে যে ভালোবাসা আছে কবি হারিসুল হক সে ভালোবাসা কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন দারুণ দক্ষতায়। নম্র উপাখ্যানে প্রিয়তমাকে যেমন প্রেমের আহ্বান জানিয়েছেন তেমনই ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন, অভিমানে নিখোঁজ হতে বলেছেন কুমারী নদীতে। স্বপ্নের অলিন্দে রাতভর ঘুরতে ঘুরতে স্বপ্নাচ্ছন্ন কবি হৃদয়ের ভেতরে পুষে রেখেছেন প্রকাশযোগ্য দিকচিহ্নহীন ক্ষীয়মান স্মৃতি।
প্রকৃতপক্ষে হারিসুল হক এমন বিরল প্রজাতির কবি, যাঁর বলার ভঙ্গি তাঁকে আলাদা করে দেয়। সমকালীন ভাষাভঙ্গির মধ্যেও এমন এক শব্দের ব্যঞ্জনা তিনি তুলে আনেন, যা অনেকের চেয়ে আলাদা। শব্দের কারিকুরি তাঁর কবিতাকে করে তুলেছে অনন্য। নান্দনিকতার মূল সুর যদি হয় সৌন্দর্য, সেই সৌন্দর্যের সফল রূপায়নের এক দক্ষ কারিগর হারিসুল হক।
সাহিত্যের পথে হারিসুল হক মূলত কবিতার প্রেমে মগ্ন হতে চাওয়া মানুষ। প্রেম এবং বিরহ তাঁর কবিতার প্রধান অনুসঙ্গ। তিনি আশির দশকের বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান এবং স্বতন্ত্র এক স্বর। ‘আরাধ্য কষ্টের মহিমায়’ কাব্যগ্রন্থে কবি হারিসুল হক পাঠককে নিয়ে যান এক চিত্রকল্পের ভেতরে। চিত্রকল্প নির্মাণ করতে যেয়ে কবি সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শব্দগুলো থেকেই শব্দ বেছে নিয়েছেন। উপমার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমেই গড়ে তুলেছেন কবিতার কলেবর। দৃশ্যের বর্ণনায়, চিত্রকল্পের বর্ণনায় মুন্সিয়ানা দেখিয়ে তৈরি করেছেন কাব্যের আখ্যান। তাঁর উপমা, চিত্রকল্প এতটাই হৃদয়গ্রাহী আর জুতসই যে, পাঠক ভুলে যান কখন সে কবিতার অতলে ডুবে গিয়েছিলেন। পালানোর ধারাপাত এমনই একটি কবিতা। এই কবিতায় জাত রোমান্টিক কবি হারিসুল হক উচ্চারণ করেন—‘পালানো শিখতে চাও/যাও সুভদ্র খরগোশের কাছে যাও/থাকো শিক্ষানবীশ কিছুকাল/শিখে এসো দৌড়ঝাঁপ, ছোটবার তুমুল ধ্রুপদী/জেনে নাও ফন্দিফিকির বাঁচবার/পড়ে নাও দৃষ্টির চতুর ইশারা যথারীতি’
হারিসুল হকের কবিতা পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হয়েছে—ভালোবাসা, বিরহ, ত্যাগ, তিতিক্ষা তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় ভাব। ফলে নারীপ্রেমের আনন্দ-বেদনা কবিতায় উঠে এসেছে বারবার। প্রেমের ক্ষেত্রে সমর্পণই হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার কেন্দ্রীয় সুর। দয়িতার কাছে সমর্পণেই তিনি খুঁজে পান প্রাপ্তির পরম আনন্দ। তাই তো মুগ্ধ পাখির নাচ কবিতায় তাকে বলতে শুনি—‘এসো সোনার ডিম ভাজি আজ রাতে/তানপুরাটা না হয় ঝরালো সুর/দু’জনই ভিজি মেঘচাঁদরাঙা জটিল বারান্দায়’। একই কবিতায় তিনি আরও উচ্চারণ করেন—‘পাখিরা যা বোঝে বন্য অভিজ্ঞতায়/মুসাফির মন তুচ্ছ ভাবেনি তাকে/আঁজলা ভরেছি গুগলি শামুক ঠাসা/শুরু হউক তবে নদীতে যুগলভাসা’
দ্বিধা আর অপূর্ণতাবোধকেও কবিতার অন্যতম অনুসঙ্গে পরিণত করেছেন হারিসুল হক। কাননে বর্ণান্ধ পাখি কবিতায় তিনি এই অপ্রাপ্তি ও অনিশ্চয়তাকে প্রকাশ করেছেন এইভাবে— ‘তুমি পছন্দ করো লালফুল আর আমি/প্রসন্ন মনে সাদা ফুল ছিঁড়ে আনি/আমি কি উদভ্রান্ত সই পুষ্পকাননে?’ এই কবিতায় তিনি আরও বলেন—‘অথচ দ্যাখো তুমি লাল ফুল পেতে চেয়েছিলে/আর আমি রাতভর সাদা ফুল করেছি চয়ন/তবে কি আমি সখি বর্ণান্ধ পাখি এক/তোমার বাগানে’
হারিসুল হকের দেখার দৃষ্টি সরল। সহজতাই তাঁর লেখার প্রাণ। সহজভাবে কী সব সুন্দর কবিতা লিখেছেন তিনি। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে একজন সচেতন পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে—হারিসুল হক মানুষের জন্য লেখেন। বিরহের কবুতর কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘আজকে না হয় দেখা না হওয়ার ছলে/পুষবো গোপনে বিরহের কবুতর/বটের নিবিড় নির্জন আলোছায়ায়/না হয় খুঁজবো স্মৃতিভুক অজগর।’
প্রেমের পাশাপাশি প্রকৃতিকেও বহুবিধ ব্যঞ্জনায় কবিতায় তুলে এনেছেন হারিসুল হক। প্রকৃতি তাঁকে লিখতে প্রাণিত করে। হারিসুল হক যেভাবে প্রেম ও প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছেন তাঁর এই দেখার দৃষ্টিভঙ্গি মনের মধ্যে সৌন্দর্যের আবেশ সৃষ্টি করে। এই কবিতাগুলো পড়লে পাঠক যেমন আনন্দ পাবেন একইসাথে প্রজ্ঞাবানও হতে পারবেন। তাঁর কবিতায় কখনো নদী-সমুদ্র বা কখনো স্বপ্নের বোবামাছ, কিংবা পুষ্পকানন হয়ে ওঠে বিবিধ ঘটনার সমীকরণ। নদীই তাঁর কাছে নারী, জীবনের সমার্থক। প্রকৃতি তাঁর কাছে দুঃখ বেদনা উপলব্ধির পরম উৎস। জীবনের না পাওয়ার নির্মমতা কবির সাথে যেন তার পাঠক আর প্রকৃতিকেও কাঁদায়। যাও নিখোঁজ হও কুমারী নদীতে কবিতায় তাইতো কবি বলেন— ‘তুমি ডুবতে শেখোনি মেঘদ নীলে/তা না হলে হারাবে কীভাবে টলমল বিষাদের জলে/কীভাবে হারাবে তবে আত্মঘাতী স্মৃতির ক্ষুভিত অনলে/মদির আঁধারে যাও লালরঙ প্রতীক্ষায় দগ্ধ করো/কামদার চূর্ণবসন বাসনার চূড়ান্ত অলিন্দে’
অথবা শুনি ছেঁড়াসঙ্গীত পাড়ভাঙা কবিতায় তাঁর আক্ষেপময় উচ্চারণ—
‘তামার চাতালে রোদ ওঠে রোজ সমুজ্জ্বল/আমার এখানে নষ্টপাখির করতালি/চোখ বুজে শুনি ছেঁড়াসঙ্গীত পাড়ভাঙা/আমার দু’হাতে ভগ্নসময় জোড়াতালি/তোমার টবেতে ফুল ফোটে ভারী তরতাজা/আমি ঘরে তুলি বিশীর্ণমৃত ঝরাপাতা/দগ্ধ-দহন জল ঝরে যায় মুগ্ধতায়/তুমি মেতে আছো সংলাপহীন মুখরতায়’
এ কবিতার মতো তাঁর আরও বহু কবিতায় প্রবল হয়ে উঠেছে অস্তিত্বগত নিঃসঙ্গতা এবং আত্মসন্ধানের হাহাকার। মানুষের মুখের ভাষাকে, তাদের মর্মবেদনাকে তিনি কবিতা করে তুলেছেন সুনিপুনভাবে। যা আমাকে টেনেছে ভীষণভাবে। স্বপ্নের বোবামাছ কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘নদী কি এখনো বিরাগ সম্ভাষণে/পাড়কে ডাকছে নিরুপায় প্রলোভনে/সাড়া যেন বা সুকুমার উদ্ভিদ/জন্ম দিচ্ছে কামনার কুর্নিশ/আকাঙ্ক্ষা বুঝি স্বপ্নের বোবামাছ/হারাতে বসেছে গুপ্ত অঙ্গুরীয়’
কবিতায় আবেগের নিয়ন্ত্রণ জানতে হয়। অতিরিক্ত আবেগ বা কম আবেগ কবিতাকে ব্যর্থ করতে পারে। হারিসুল হক তাঁর কবিতায় আক্ষেপ, বিরহকে শিল্পের সাথে সংযুক্ত করেছেন দারুণ মুন্সিয়ানায়। নিয়ন্ত্রিত আবেগের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে করেছে মানোত্তীর্ণ। না পাওয়ার বেদনা, হাহাকার বারবার শিল্পের মাধুর্য হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। ঝাপসা বিকেলে একদিন কবিতায় তাঁকে বলতে শুনি—‘কষ্টের শ্বাস বরাবরই টান টান/প্রাপ্তির ঘরে অফুরান দৈন্যতা/স্মৃতি অতি ছোট শিমুলের কালোবীজ/ভেতর ভর্তি আবেগের পেঁজো তুলা’
এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করবেন কাব্যিক পরিভ্রমণে ক্লান্তিহীন হারিসুল হক প্রেমের দিকে তাঁর যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন প্রতিনিয়ত। নিঃসঙ্গতাকে, ব্যক্তিগত আক্ষেপকে তিনি তুলে এনেছেন সুনিপুণভাবে। তাইতো বিপ্রতীপ কবিতায় তাঁর উচ্চারণ— ‘আপনি যখন ছিলেন না/আমি অপেক্ষায় ছিলাম/আপনি যখন যাচ্ছিলেন/আমি অন্য পথে/আপনি যখন বাসে/তখন আমি ফিরছিলাম/আপনি যখন হ্রদে/তখন আমি শয্যায়/আপনি যখন মাঠে/ আমি তখন স্নানে/আপনি যখন এলেন/আমি তখন ছিলাম না’
কবি হারিসুল হক এক অনন্য কবিজীবন যাপন করেন। আধুনিক বাস্তবতা আর চর্চিত কল্পনার ভেতর কবি আমাদের দেখান জীবনের এক অপরিহার্য শিল্পসত্য। তাঁর এক একটা কবিতা পড়তে পড়তে উপলব্ধি করেছি মনের প্রশান্তি। হতাশাকে প্রেমের শক্তিতে রূপান্তর করার বড় কারিগর কবি হারিসুল হক। অপূর্ণ আমি জাগি কবিতায় তিনি বলেন—‘স্মৃতিতে আমার আজদাহা এক সাপ/চাটছিলো ঠোঁট চরম অস্থিরতায়/আসছে প্রহর সঙ্গীন আবহাওয়া/কেটে যায় দিন অবাধ্য শিশুক্রীড়ায়’। অন্যদিকে, ঝাপসা বিকেলে একদিন কবিতায় তিনি এক আহত কবি। নিদারুণ আঘাতে বলে উঠেছেন—‘ছেলেবেলাকার ঝাপসা বিকেলে একটি হাসি স্মিত/জাগিয়ে রেখেছে ফিনিক্স পাখিকে অবিরাম অবিরত’
হারিসুল হকের ‘আরাধ্য কষ্টের মহিমায়’ পাঠ শেষে মনে হয়—অপূর্ব শব্দ বিন্যাসে ব্যক্তিগত শোক-দুঃখ আর ক্ষোভ-অভিমানকে অপরিহার্য শিল্প সত্ত্বায় রূপান্তরিত করেছেন তিনি। তাঁর কবিতার প্রধান শক্তি হলো পাঠককে সম্মোহন করা। প্রেম-ভালোবাসাকে কাব্যকলায় নান্দনিক রূপ দেয়ার মাধ্যমে একেবারে অন্তর্মূলে বিঁধে যাওয়ার মতো বহু কবিতা লিখেছেন তিনি। ফলে তাঁর কবিতায় প্রেম যেমন চিরায়ত তেমন তা বহুল ব্যবহৃতও। তবে হারিসুল হকের বাহাদুরিটা এই যে—বহুলচর্চিত এসব বিষয়কে তিনি কবিতার অনুষঙ্গ করেছেন দারুণ দক্ষতার সাথে। প্রেমের প্রথাগত বাহন ‘তুমি’ শব্দটি যে নানামাত্রিক অর্থদ্যোতনায় ব্যবহৃত হতে পারে, তা হারিসুল হকের কবিতা পাঠে আরও একবার উপলব্ধি করবে সচেতন পাঠক।
মর্তুজা হাসান সৈকত: কবি ও কলামিস্ট। জন্ম: সিরাজদিখান, মুন্সিগঞ্জ। আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেছেন। যুগান্তর, বিডি নিউজ টুয়েন্টি ফোর, আজকের পত্রিকা, আমাদের সময়, জনকণ্ঠ,জাগো নিউজ টুয়েন্টি ফোর, রাইজিংবিডিসহ শীর্ষস্থানীয় প্রিন্ট এবং অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত নিবন্ধ লিখছেন।