সেলিনা আক্তার:
বড় অঙ্কের মুনাফা অর্জন করলেও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানি ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ শুল্ক-কর বাবদ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ফাঁকি দিয়েছে।
নানা কৌশলে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট, সারচার্জ ও উৎসে ভ্যাট বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে। ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের গোয়েন্দা তদন্তে এমন ফাঁকির বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে। আছে তদন্ত-কাজে চরম অসহযোগিতার অভিযোগও।
আমদানি থেকে উৎপাদন পর্যায়ে দফায় দফায় নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে অনিয়মের প্রমাণ মেলার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। যা এখন পুনরায় যাচাই-বাছাই পর্যায়ে আছে। শিগগিরই বৃহৎ করদাতা ইউনিট থেকে দাবিনামা জারি করা হতে পারে বলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
ঢাকা টোব্যাকো নেভি, শেখ, মালবোরো, নেভি ব্লু, ফাইভ স্টার ও গোল্ড মাইন সিগারেট উৎপাদন করে থাকে। বছরে স্থানীয় বাজারে তিন থেকে চার হাজার কোটি শলাকা সিগারেট সরবরাহ করে। এমনকি রপ্তানিও করে প্রতিষ্ঠানটি। আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি জাপান টোব্যাকো (জেটি) গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যদিও শুল্ক-ভ্যাট ফাঁকির ওই তথ্য আকিজ গ্রুপে থাকাকালীন। তাই ভ্যাট গোয়েন্দাদের উদঘাটিত ওই ফাঁকির টাকা ঢাকা টোব্যাকোকে অর্থাৎ আকিজ গ্রুপকে পরিশোধ করতে হবে বলে জানা গেছে
গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত ঢাকা টোব্যাকো নেভি, শেখ, মালবোরো, নেভি ব্লু, ফাইভ স্টার ও গোল্ড মাইন সিগারেট উৎপাদন করে থাকে। বছরে স্থানীয় বাজারে তিন থেকে চার হাজার কোটি শলাকা সিগারেট সরবরাহ করে। এমনকি রপ্তানিও করে প্রতিষ্ঠানটি। আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি জাপান টোব্যাকো (জেটি) গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। যদিও শুল্ক-ভ্যাট ফাঁকির ওই তথ্য আকিজ গ্রুপে থাকাকালীন। তাই ভ্যাট গোয়েন্দাদের উদঘাটিত ওই ফাঁকির টাকা ঢাকা টোব্যাকোকে অর্থাৎ আকিজ গ্রুপকে পরিশোধ করতে হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির উদ্দিনের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
তবে, গ্রুপটির ট্যাক্স ও ভ্যাট বিভাগের এজিএম রুহুল আমিন বলেন, সিগারেট উৎপাদনে কাঁচামাল পর্যায়ের ভ্যাট ও শুল্কের দাবি নিয়ে মূলত মতবিরোধ। আমাদের ওই কোম্পানির পাশাপাশি অন্য একটি কোম্পানির কাছেও বড় অঙ্কের ভ্যাট দাবি করা হয়েছিল। সেটির মীমাংসা হয়ে গেছে।
‘আমাদের কাছেও ভ্যাট গোয়েন্দারা বড় অঙ্কের ভ্যাট-শুল্ক দাবি করলেও এত টাকা তারা পাবে না। আমরা এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আপত্তিও জানিয়েছি। বিষয়টি মীমাংসার পর্যায়ে আছে। আশা করছি খুব শিগগিরই মীমাংসা হয়ে যাবে।’
বিপুল অঙ্কের কর ফাঁকির বিষয়ে আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির উদ্দিনের সঙ্গে পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। মুঠোফোনে কল ও মেসেজ দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো জবাব দেননি।
ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবদুর রউফের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি ‘তদন্ত চলমান’ বলে জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আর কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি তিনি।
যদিও এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ একটি বৃহৎ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। সিগারেট উৎপাদনের মূল উপকরণ হলো তামাক। এ ছাড়া, বেশকিছু কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়। সিগারেটে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সারচার্জ, আয়কর ও ভ্যাট রয়েছে। তদন্তে উদঘাটিত রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ কম বা বেশি হতে পারে। আমাদের গোয়েন্দা টিম অনেক সময় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে আমরা দেখতে পেয়েছি, প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছাকৃতভাবে দলিলপত্র দাখিল করেনি। শুধু তা-ই নয়, তারা নানা কৌশলে ভ্যাট গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করেছেন। তাই এনবিআর মনে করে, আইনের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অসম্মান এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বের মনোভাবই প্রমাণ করে যে এখানে বড় ধরনের ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি।
যেভাবে শুল্ক-ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটন হয়েছে
সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ৮ জুন ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজের ভ্যাট বা মূসক সংক্রান্ত কার্যক্রম নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সেই উদ্দেশ্যে একজন সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে আট সদস্যের টিম গঠন করা হয়। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটি টিমকে নথিপত্র সরবরাহ করেনি। তদন্ত টিমকে রেকর্ডপত্র পেতে পর্যায়ক্রমে নয়টি পত্র প্রেরণ করতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নথিপত্র দাখিল না করায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অনিয়মের মামলাও দায়ের হয়েছিল। পরবর্তীতে ঢাকা টোব্যাকো কিছু নথিপত্র সরবরাহ করলে প্রাথমিক অডিট প্রতিবেদন প্রস্তুত করে টিম। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আপত্তি জানালে গঠিত হয় পুনঃপর্যালোচনা কমিটি। ওই কমিটিও বিভিন্ন দলিলাদি দাখিলের জন্য একাধিক পত্র প্রদান করে। সেখানেও নথিপত্র সরবরাহ না করাসহ বিভিন্নভাবে অসহযোগিতার প্রমাণ মিলেছে ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে।
আমাদের গোয়েন্দা টিম অনেক সময় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে আমরা দেখতে পেয়েছি, প্রতিষ্ঠানটি ইচ্ছাকৃতভাবে দলিলপত্র দাখিল করেনি। শুধু তা-ই নয়, তারা নানা কৌশলে ভ্যাট গোয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করেছেন। তাই এনবিআর মনে করে, আইনের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির অসম্মান এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্বের মনোভাবই প্রমাণ করে যে এখানে বড় ধরনের কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। আমরা আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)
পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানের হিসাব বিবরণী, ভ্যাট দলিল ও সিএ ফার্মের বার্ষিক প্রতিবেদনসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র যাচাই করে রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি সামনে আসে। রাজস্ব পরিশোধ না করার হিসাব নিরূপণ করে টিম। নথিপত্র সরবরাহে গড়িমসির কারণ খুঁজতে গিয়ে ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ বিক্রি করে মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়টি নজরে আসে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে নিরীক্ষার দলিলাদি দাখিলে বিলম্ব করে রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ লুকানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল— মনে হয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দাদের কাছে।
প্রতিষ্ঠানের ঘোষণাপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিগারেট উৎপাদনের তামাক পাতা, এসিটেট পে, সিগারেট পেপার, টিপিং পেপার, এডহেসিভ, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল, গ্লিসারিন, কার্টন, প্লাগ র্যাপ/হোয়াইট বেজ পেপার, বিওপিপি, কেমিক্যালস, শেল ও স্লাইড ব্যবহৃত হয়। ঢাকা টোব্যাকোর রাজস্ব পরিহারের হিসাবের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন মূল্যের সিগারেট বিবেচনায় নেয় টিম। প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজের হেড অফিস আকিজ ভবনের সফটওয়্যার সরেজমিন যাচাই করা হলেও কম্পিউটারে সংরক্ষিত কিছু তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সার্ভারের রক্ষিত কোনো তথ্য দেখাতে সক্ষম হননি তারা। প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দীর্ঘ সময় সহযোগিতা না করে শেষ পর্যায়ে এসে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য প্রদান করে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালায় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ভ্যাট গোয়েন্দার দুই টিম যা পেয়েছে
প্রথম কমিটি বা টিমের উদঘাটন-
২০১৭ সালের ৮ জুন ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালকের নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রথম অডিট কমিটি বা টিম গঠন করা হয়। ওই টিম প্রতিষ্ঠানটির ক্রয় হিসাব পুস্তক, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র (মূসক- ১৯), চলতি হিসাব পুস্তক, বার্ষিক অডিট রিপোর্ট ও দাখিল করা হিসাব বিবরণী ইত্যাদি মূসক আইনের বিদ্যমান বিধিবিধান অনুসারে যাচাই করে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অপরিশোধিত বা ফাঁকি দেওয়া সম্পূরক শুল্ক বাবদ নয় হাজার ৬৪৬ কোটি ৮৪ হাজার ১৮২ টাকা এবং ভ্যাট বা মূসক বাবদ দুই হাজার ৫৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ৭২ হাজার ৭৩৫ টাকার অপরিশোধিত রাজস্ব ফাঁকির হিসাব পায়। যা সুদ বাবদ ১০ হাজার ৭২০ কোটি ৬৪ লাখ ১০ হাজার ৫৭ টাকা এবং স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ পরিহার করা ১৫৩ কোটি ৯৫ লাখ ৩৪ হাজার ৫২০ টাকা উদঘাটিত হয়। সবমিলিয়ে ২৩ হাজার ১১৯ কোটি ৯২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৯৫ টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রাথমিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ আপত্তি করায় পুনঃযাচাই কমিটি/টিম গঠন করা হয়।
নথিপত্র সরবরাহে গড়িমসির কারণ খুঁজতে গিয়ে ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ বিক্রি করে মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়টি নজরে আসে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে নিরীক্ষার দলিলাদি দাখিলে বিলম্ব করে রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ লুকানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল— মনে হয়েছে ভ্যাট গোয়েন্দাদের কাছে
পুনঃযাচাই কমিটি বা টিমের উদঘাটন-
ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজের আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের দ্বিতীয় টিম গঠিত হয়। পুনঃযাচাই কমিটি বা টিম প্রথম কমিটির প্রাথমিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দাখিল করা দলিলপত্র, বিভিন্ন উৎস হতে (যেমন- ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট কমিশনারেট) সংগৃহীত দলিল, প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য ইত্যাদি পর্যালোচনা করে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত অপরিশোধিত বা ফাঁকি দেওয়া সম্পূরক শুল্ক বাবদ আট হাজার ২৮০ কোটি ১৮ লাখ ১২ হাজার ৪০২ টাকা, ভ্যাট বাবদ দুই হাজার ৩৪৩ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ১১৪ টাকা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ ১৪২ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯০ টাকা, অপরিশোধিত উৎসে মূসক বাবদ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬৩ টাকার তথ্য পায়। সবমিলিয়ে ১০ হাজার ৭৯১ কোটি ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৯ টাকার রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করে কমিটি। মূল্য সংযোজন কর আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৩৭ (৩) অনুযায়ী পরবর্তী তারিখ হতে পরিশোধের তারিখ পর্যন্ত সুদ পরিশোধযোগ্য।
রাজস্ব ফাঁকির চূড়ান্ত খতিয়ান
দীর্ঘ ছয় বছরের নথি চালাচালি ও আপত্তিপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত হিসাব তৈরি করে ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের বিশেষ গোয়েন্দা টিম। চলতি বছরের ১২ এপ্রিল প্রতিবেদন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর দাখিল করার পর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) পাঠানো হয় শুল্ক ও ভ্যাট আদায় করার জন্য। পরবর্তীতে এনবিআর চেয়ারম্যান সংস্থাটির একজন সদস্যকে বিষয়টি আরও যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনা দেন। ওই যাচাই-বাছাই এখনও চলমান রয়েছে বলে জানা গেছে।
পুনঃযাচাই কমিটি বা টিম প্রথম কমিটির প্রাথমিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দাখিল করা দলিলপত্র, বিভিন্ন উৎস হতে (যেমন- ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট কমিশনারেট) সংগৃহীত দলিল, প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য ইত্যাদি পর্যালোচনা করে ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত অপরিশোধিত বা ফাঁকি দেওয়া সম্পূরক শুল্ক বাবদ আট হাজার ২৮০ কোটি ১৮ লাখ ১২ হাজার ৪০২ টাকা, ভ্যাট বাবদ দুই হাজার ৩৪৩ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ১১৪ টাকা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ ১৪২ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯০ টাকা, অপরিশোধিত উৎসে মূসক বাবদ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬৩ টাকার তথ্য পায়। সবমিলিয়ে ১০ হাজার ৭৯১ কোটি ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৯ টাকার রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করে কমিটি
গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ কাঁচামাল থেকে চূড়ান্ত উৎপাদন পর্যন্ত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক বাবদ ফাঁকি দিয়েছে এক হাজার ১৬৬ কোটি ৩৪ লাখ ১৬ হাজার ১৫৯ টাকা। এরপর ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সম্পূরক শুল্ক বাবদ যথাক্রমে দুই হাজার ৬৪ কোটি ১৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪৫৮ টাকা, তিন হাজার ৪০৮ কোটি ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ১২৪ টাকা এবং এক হাজার ৬৪০ কোটি ৯৪ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬১ টাকা ফাঁকি বা অপরিশোধিত রাজস্বের হিসাব পাওয়া যায় প্রতিবেদনে। সর্বমোট সম্পূরক শুল্ক বাবদ আট হাজার ২৮০ কোটি ১৮ লাখ ১২ হাজার ৪০২ টাকা ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়।
অন্যদিকে, সিগারেট উৎপাদনে ব্যবহৃত তামাকসহ বিভিন্ন কাঁচামালে ভ্যাট বাবদ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২০২ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার ৭৬৭ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৬৪৫ কোটি পাঁচ লাখ ৩১ হাজার ৮১ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ২২ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭ টাকা এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ভ্যাট বাবদ ফাঁকি দেওয়া হয়েছে ৪৭৩ কোটি ৩৪ লাখ ৯৪ হাজার ২২৯ টাকা। সবমিলিয়ে তামাক ব্যবহারে ভ্যাট বাবদ দুই হাজার ৩৪৩ কোটি ৮৫ লাখ ৭০ হাজার ১১৪ টাকা অপরিশোধিত অবস্থায় পাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বাবদ ১৪২ কোটি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার ৬৯০ টাকার ফাঁকি উদঘাটিত হয়েছে। যার মধ্যে ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সারচার্জ বাবদ যথাক্রমে ৪৩ কোটি ৩৫ হাজার ৪০৫ টাকা, ৬৮ কোটি ১৭ লাখ ৩৭ হাজার দুই টাকা, ৩১ কোটি ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার ২৮২ টাকার সারচার্জ বকেয়া বা অপরিশোধিত হিসাবে প্রমাণ মিলেছে।
আমাদের কাছেও ভ্যাট গোয়েন্দারা বড় অঙ্কের ভ্যাট-শুল্ক দাবি করলেও এত টাকা তারা পাবে না। আমরা এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আপত্তিও জানিয়েছি। বিষয়টি মীমাংসার পর্যায়ে আছে। আশা করছি খুব শিগগিরই মীমাংসা হয়ে যাবে
আকিজ গ্রুপের ট্যাক্স ও ভ্যাট বিভাগের এজিএম রুহুল আমিন
এ ছাড়া, অপরিশোধিত উৎসে মূসক বা ভ্যাট বাবদ ২৪ কোটি ৪৬ লাখ ৭৩ হাজার ৫৬৩ টাকার তথ্য মিলেছে। সবমিলিয়ে শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ বাবদ ১০ হাজার ৭৯১ কোটি ২৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৯ টাকার রাজস্ব ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করে কমিটি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঢাকা টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রিজ গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত। প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিটির মূল প্রতিষ্ঠান ছিল আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের। প্রতিষ্ঠানটিতে দেড় হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। কোম্পানিটি সিগারেট ও তামাক রপ্তানি করে থাকে। বিশ্বের বৃহত্তম পাঁচ তামাক কোম্পানির একটি জাপান টোব্যাকো (জেটি) গ্রুপ ২০১৮ সালে ১২ হাজার ৪৩০ কোটি টাকায় (১৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার) আকিজ গ্রুপের সিগারেট তৈরির সম্পূর্ণ ব্যবসা কিনে নেয়। এটি ছিল বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে একক বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগ। দেশের বাজারে জাপান টোব্যাকো বর্তমানে এলডি, নেভি, শেখ, কে ২, রিয়েলসহ কয়েকটি ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি করছে।
জাপান টোব্যাকো বিশ্বের ১৩০টি দেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করে প্রায় ৬০ হাজার কর্মী। তারা উইনস্টন, ক্যামেল, মেভিয়াস ও এলডি ব্র্যান্ডের সিগারেট বাজারজাত করে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচিত ব্র্যান্ড। বিএটির মতো তামাকের পাশাপাশি জাপান টোব্যাকো ই-সিগারেট বাজারজাত করে থাকে বলে জানা গেছে।