২৩ বছর পর কারামুক্ত হয়ে জানলেন পরিবারের কেউ বেঁচে নেই
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
জেলা প্রতিনিধি,লালমনিরহাটঃ
ধর্ষণের ঘটনায় দুই আসামিকে সহযোগিতা করার অপরাধে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগের পর লালমনিরহাট কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন রেখা খাতুন (৪৪) নামে এক নারী। তবে মুক্তি পেলেও ঘরে ফেরার তাড়া নেই তার। কারণ তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
রেখা খাতুনের বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট এলাকায়। ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর শিশু ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার হন রেখা খাতুন (৪৪)। ওই মামলায় বাকি দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে জামিন লাভ করলেও কারাগার থেকে বের হতে পারেননি রেখা। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছর কারাভোগ করতে হয়েছে তাকে।
গত মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।দীর্ঘ ২৩ বছর পর জেল থেকে বেরিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কারণ জানতে পারেন তার পরিবারে আর কেউ বেঁচে নেই। এখন কোথায় তার ঠিকানা কিছুই জানেন না তিনি।
রেখা খাতুন বলেন, পরিবারের সবাই মারা গেছেন। এমনকি আমার স্বামী বিয়ে করে অন্য আরেকজনের সঙ্গে সংসার করছেন। আমি জেলে থাকা অবস্থায় মা-বাবা, দুই বোন আর এক ভাইসহ ২৫ আত্মীয় মারা গেছে। এখন কোথায় যাব? আমার কাছে আর কোনো ঠিকানা নেই।
২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রেখা খাতুনসহ তিন আসামি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। সেই সঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। তবে রেখা খাতুনের দাবি, শিশু ধর্ষণের ঘটনা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না।জানা গেছে, রেখার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর শেষ হয়। এরপর জরিমানার এক লাখ টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাকে আরও তিন বছর কারাগারে আটক থাকতে হতো। সেই হিসাবে তাকে ২০২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত লালমনিরহাট জেলা কারাগারে থাকতে হতো। বিষয়টি জানতে পেরে রেখা খাতুনের মুক্তির জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, লালমনিরহাট-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মতিয়ার রহমান, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্যাহ ও লালমনিরহাট পৌরসভার মেয়র মো. রেজাউল করিম স্বপন। তারা সম্মিলিতভাবে জরিমানার টাকা ৮ এপ্রিল ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করে দেন। এর ফলে ঈদের দুই দিন আগে ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে তত দিনে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বাইরে অতিরিক্ত আরও চার মাস ছয় দিন কারাভোগ করেছেন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে রেখা খাতুন বলেন, ‘আমি জেলে যাওয়ার পর আমার স্বামী কোরবান আলী দ্বিতীয় বিয়ে করে। এখন কোথায় আছে, কেউ বলতে পারে না। আমার বাবার বাড়িটা ধরলা নদীর পেটে চলে গেছে। স্বামীর অবর্তমানে বাবার বাড়িতে জীবনের বাকি দিনগুলোতে কাটানোর স্বপ্নটাও ভেঙে গেছে।’
তাই রেখা খাতুনের মনে এখন একটাই প্রশ্ন, ‘কোথায় যাব আমি?’
রেখা খাতুনের বাবার ভিটা ধরলা নদীতে কলাখাওয়া ঘাটে বিলীন হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগে রেখার বাবা ফজলু রহমান মারা যান। আর মা নূরনাহার বেগম মারা যান ১২ বছর আগে। তাদের কবরও গ্রামের বাড়িতে হয়নি। পাশের জেলা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের কবির মামুদ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। ওই গ্রামে রেখার ছোট বোন টুম্পা বেগমের বিয়ে হয়। কারামুক্তির পর টুম্পার শ্বশুরবাড়িতেই রেখা আশ্রয় নিয়েছেন।
দারিদ্র্যের কারণে ১৩-১৪ বছর বয়সে রেখা খাতুনের বিয়ে হয়। তার স্বামী কোরবান আলী তখন ৩৪ বছরের যুবক ও পেশায় দিনমজুর ছিলেন। বিয়ের পরও দুই-তিন বছর বাবার বাড়িতে থেকে ১৯৯৮ সাল থেকে স্বামীর বাড়িতে থাকতে শুরু করেন রেখা। রেখা ও তার স্বামী কোরবান আলী লালমনিরহাট শহরের খোচাবাড়ি এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন যেখানে এখন অন্য কেউ থাকেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুই আসামি লালমনিরহাট শহরের নর্থ বেঙ্গল মোড় এলাকার দুলাল হোসেনের ছেলে আলমগীর হোসেন ও লালমনিরহাট শহরের কুড়াটারি গ্রামের ভোলা মিয়ার ছেলে ফরিদ হোসেন। রায় ঘোষণার সময় ফরিদ হোসেন পলাতক ছিলেন। পরে গ্রেপ্তার হন। ওই দুই আসামি চার-পাঁচ বছর জেল খেটে উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন। এর মধ্যে আলমগীর হোসেন দাম্পত্য কলহের জের ধরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আর ফরিদ হোসেন লালমনিরহাট শহরের একটি হোটেলে বাবুর্চির কাজ করেন।
নারী অধিকার সংগঠক ফেরদৌসী বেগম বলেন, রেখা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে তার জীবনের গল্প আমরা শুনেছি। সেই হিসেবেই লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলে তার মুক্তির বিষয়ে ব্যবস্থা করেছি।
রেখার জরিমানার টাকার অঙ্ক ১ লাখ টাকা হলেও তিনি অতিরিক্ত চার মাস ছয় দিন কারাগারে সাজা ভোগ করায় জরিমানা থেকে ১০ হাজার টাকা মওকুফ হয়ে যায়। এর বাইরে রেখা কারাগারে অবস্থানকালে শ্রমের বিপরীতে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করেন। ওই টাকা সমন্বয় হয়ে ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। সংসদ সদস্য, জেলা প্রশাসক ও পৌরসভার মেয়র সম্মিলিতভাবে ওই টাকা দিয়েছেন। ৯ এপ্রিল সকালে রেখা খাতুনকে লালমনিরহাট জেলা কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
লালমনিরহাট জেল সুপার মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘কারাগারে রেখা খাতুনকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি হস্তশিল্পের কাজ করে উপার্জন করতে পারবেন। রেখা ২৩ বছর ৪ মাস ৫ দিন লালমনিরহাট জেলে কাটিয়েছেন। ওই নারী অত্যন্ত ভালো মানুষ। কারাগারে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছিলেন।
লালমনিরহাট-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মতিয়ার রহমান বলেন, রেখা খাতুনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সবকিছু শুনেই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে কিভাবে পুনর্বাসন করা যায় সেই ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।