জেলা প্রতিনিধি বরিশালঃ
বরিশালের আগৈলঝাড়ায় গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ২৪৩ বছরের প্রাচীণ মারবেল মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোমবার (১৫ জানুয়ারি) উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রামানন্দের আক গ্রামে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তিতে এ মেলার আয়োজন করা হয়। মেলায় শুধু আগৈলঝাড়া উপজেলাই নয়, পার্শ্ববর্তী কোটালীপাড়া, উজিরপুর, ডাসার, কালকিনি, গৌরনদী, বানারীপাড়া, বাকেরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন।
মারবেল খেলার মূল রহস্য সম্পর্কে স্থানীয় প্রকাশ বিশ্বাস জানান, আমাদের পূর্বপুরুষরা এ খেলার মাধ্যমে মেলার প্রচলন করেছিলেন। যা আজও অব্যাহত আছে। তাদের উত্তরসূরী হিসেবে আমরা সেই প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। মারবেল মেলা উপলক্ষে ওই বাড়ির মেয়ে শিখা বিশ্বাস পরিবারসহ ঢাকা থেকে এসেছেন।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলা থেকে মারবেল খেলার জন্য এসেছেন সৈকত বিশ্বাস। বাগধা গ্রাম থেকে নমিতা মন্ডল পরিবারের সকলকে নিয়ে এসেছেন মারবেল মেলায়।
মেলায় আসা দর্শনার্থীরা জানান, মেলায় এসে মারবেল খেলতে পেরে ভালো লাগছে। এই দিনটি ঘিরে রামানন্দের আক গ্রামে মহোৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের মেয়ে জামাইসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের এ মারবেল মেলায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আসছেন।
কোটালীপাড়া উপজেলা থেকে মেলায় আগত প্রভাষক তরুন চন্দ্র নাথ জানান, এ এলাকার ঐতিহ্যবাহী মারবেল খেলার কথা শুনে মেলায় এসেছি। মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানীরা।
স্থানীয় রামানন্দের আক মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠ ও কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মারবেল খেলা চলছে। রাস্তার ওপর, বাড়ির আঙিনা, অনাবাদী জমি, বাগানসহ সর্বত্রই মারবেল খেলার আসর বসেছে। বিদ্যায়ল মাঠে বসেছে বাঁশ বেত শিল্প সামগ্রী, মনিহারী, খেলনা, মিষ্টি, ফলসহ বিভিন্ন ধরনের দোকান।
বাশাইল গ্রামের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র দিনেশ রায় ও দশম শ্রেণির ছাত্র শুভ সমদ্দার জানান, সারা বছর টাকা জমিয়েছি মারবেল খেলার জন্য। শিশু থেকে শুরু করে কিশোর, কিশোরী, তরুণ-তরুণীরাও মেলার প্রধান আকর্ষণ মারবেল খেলায় অংশগ্রহণ করেন।
মেলার আয়োজক কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, মেলায় মারবেল খেলার জন্য অনেকে দূরদূরান্ত থেকে এসেছেন। তাদের জন্য আগে থেকেই ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
মেলা কমিটির সভাপতি রাম কৃষ্ণ হালদার জানান, রামানন্দের আক গ্রামে ২৪৩ বছর আগে আউলিয়া মা সোনাই চাঁদের ৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়। ৭ বছর বয়সে স্বামী মারা গেলে নিঃসন্তান অবস্থায় শ্বশুরবাড়িতে একটি নিম গাছের গোড়ায় শিবের আরাধনা ও পূজা অর্চনা আরম্ভ করেন তিনি। ক্রমশ তার অলৌকিকত্ব ছড়িয়ে পড়লে ওই স্থানে বাৎসরিক পূজার আয়োজন করা হয়। মা সোনাই চাঁদ আউলিয়ার জীবদ্দশায় আনুমানিক ১৭৮০ইং সাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি প্রতিবছর পৌষ সংক্রান্তির দিনে নবান্নের অয়োজনের মাধ্যমে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তার মৃত্যুর পর ওই বাড়িটি সোনাই আউলিয়ার বাড়ি হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করে।
তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর এই দিনটি উপলক্ষে বৈষ্ণব সেবা, নাম সংকীর্তন, কবিগান শেষে সোয়ামণ (৫০ কেজি) চালের গুঁড়ার সঙ্গে সোয়ামণ আখের গুড়, ৫০ জোড়া নারকেল ও প্রয়োজনীয় কলাসহ অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে নবান্ন তৈরি করে মেলায় আগত দর্শনার্থীদের প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম আকর্ষণ পৌষ সংক্রান্তিতে বাস্তুপূজা উপলক্ষে ২৪৩ বছর ধরে এ গ্রামে মারবেল মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
আগৈলঝাড়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জহিরুল ইসলাম জানান, গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মারবেল মেলায় আগত দর্শনার্থীদের জন্য সকল ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।