৪৪ কোটির চিকিৎসাযন্ত্র কেনার পরও সেবাবঞ্চিত রোগী,মানবাধিকার কমিশনের তদন্তের নির্দেশ

প্রকাশিত: ১:৪৮ অপরাহ্ণ, মে ৭, ২০২৪

মোঃ সাইফুল ইসলামঃ 

‘৪৪ কোটি টাকার চিকিৎসাযন্ত্র অচল, সেবাবঞ্চিত রোগী’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে স্বপ্রণোদিত অভিযোগ (সুয়োমোটো) গ্রহণ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

স্বপ্রণোদিত অভিযোগটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চিকিৎসা সেবা একটি মৌলিক মানবাধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিতকল্পে বিপুল জনসংখ্যার একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশে চিকিৎসা খাতে যেখানে সরকারকে প্রতি বছর ব্যাপক পরিমাণ ভর্তুকি প্রদান করতে হয় সেখানে জনগণের ট্যাক্সের অর্থে কেনা চিকিৎসা সরঞ্জাম জনসেবায় ব্যবহৃত না হওয়ার বিষয়টি অনভিপ্রেত এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

মঙ্গলবার(৭ মে) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইউশা রহমান স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।ইউশা রহমান জানান, ‘৪৪ কোটি টাকার চিকিৎসাযন্ত্র অচল, সেবা বঞ্চিত রোগী’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনটি জাতীয় মানবাধিকার নজরে এসেছে। এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বপ্রণোদিত অভিযোগ (সুয়োমোটো) গ্রহণ করেছে।

কমিশনের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপপরিচালক সুস্মিতা পাইক স্বাক্ষরিত সুয়োমোটোতে উল্লেখ করা হয়, মানিকগঞ্জে অবস্থিত সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসায় ৮০টি শয্যা রয়েছে। তবে সবসময় ধারণ ক্ষমতার বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। দৈনিক ৮০ থেকে ৯০ জনের এনজিওগ্রাম করার প্রয়োজন হয়। এসব রোগীর মধ্যে যাদের চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য রয়েছে, তাদের ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাকিরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হন। অথচ এই হাসপাতালে চার বছর ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে ১৯ কোটি টাকা দামের দুটি ক্যাথল্যাব। স্থাপনের জায়গা ও জনবল সংকটে এতদিনেও এনজিওগ্রাম ও হার্টের রিং বসানোর এসব মেশিন চালু করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া ১৮ কোটি টাকা দামের এমআরআই মেশিন তিন বছরেও চালু হয়নি। ৬ কোটি টাকার ডিজিটাল এক্সরে মেশিন পড়ে আছে এবং ব্রেস্ট ক্যানার চিকিৎসার জন্য আনা ১ কোটি টাকার মেমোগ্রাম বিকল।

২০২০-২১ অর্থবছরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রেড হাউস ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এইচটিএমএস প্রতিষ্ঠান দুটি ক্যাথল্যাব সরবরাহ করে। এরপর এসব প্রতিষ্ঠানের কারিগরি টিমের সহযোগিতায় মেশিন দুটি স্থাপিত হয় কিন্তু এখনও ক্যাথল্যাবের ওয়াশরুম তৈরি হয়নি। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত লোকবল না থাকায় ক্যাথল্যাব চালু করা যায়নি। ট্রেড হাউস তাদের সরবরাহ করা ক্যাথল্যাবের জন্য একটি ওয়াশরুম তৈরি করছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএস এখনও সেই উদ্যোগ নেয়নি।

সম্প্রতি তিনজন নার্স ও দু’জন টেকনিশিয়ানকে ঢাকায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। তারা এক মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর ক্যাথল্যাব চালু করা হবে বলে জানানো হয়। এ ছাড়া এমআরআই মেশিনটি কারিগরি ত্রুটির কারণে চালু করা যায়নি। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএসকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তাদের টেকনিশিয়ান এসে দেখে গেছেন। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।

এছাড়া গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ হাসপাতালে ১০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন করা হলেও জনবল সংকটে চালু করা সম্ভব হয়নি। সব সুযোগ থাকার পরও শুধু প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাবে সেটি চালু করা যাচ্ছে না। এতে রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ২০২১ সালে ৪০ শয্যার সিসিইউ চালু করা হয়েছে। কিন্তু দুটি ক্যাথল্যাব মেশিন চালু না হওয়ায় এনজিওগ্রাম করা যাচ্ছে না। এদিকে এবিজি মেশিনের রি-এজেন্ট না থাকায় সেটিও ব্যবহার করা যাচ্ছে না।

স্বপ্রণোদিত অভিযোগটিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘চিকিৎসা সেবা একটি মৌলিক মানবাধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিতকল্পে বিপুল জনসংখ্যার একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশে চিকিৎসা খাতে যেখানে সরকারকে প্রতি বছর ব্যাপক পরিমাণ ভর্তুকি প্রদান করতে হয় সেখানে জনগণের ট্যাক্সের অর্থে কেনা চিকিৎসা সরঞ্জাম জনসেবায় ব্যবহৃত না হওয়ার বিষয়টি অনভিপ্রেত এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

স্বপ্রণোদিত অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময় দেখা যায় যে, হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি থাকলেও সরকারি অর্থ তছরুপ করতে অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়, যা চালানোর জন্য প্রশিক্ষিত জনবল থাকে না। ফলে এ সব যন্ত্রপাতি পড়ে থাকতে থাকতে একসময় বিকল হয়ে পড়ে। যে প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা সরঞ্জাম চালানোর মতো প্রশিক্ষিত জনবল নেই, সে প্রতিষ্ঠানে অযথা যন্ত্রপাতি কিনে একদিকে যেমন সরকারি অর্থ নষ্ট হয় অন্যদিকে যেখানে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি প্রয়োজন সেখানে মানুষ মৌলিক সেবা হতে বঞ্চিত হয়। দরিদ্র দেশে সরকারি অর্থায়নে কেনা যন্ত্রপাতি প্রশিক্ষিত ব্যক্তি দ্বারা সঠিকভাবে পরিচালনা করা হলে অনেক রোগীকে বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো না এবং অসহায় মানুষগুলো মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতো। তাই চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ক্রয়ে সঠিক সমন্বয় সাধন করে মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরও যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন বলে কমিশন মনে করে।

এ অবস্থায়, মানিকগঞ্জে অবস্থিত সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৪ কোটির টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম কাদের অবহেলায় এতদিন অব্যবহৃত ছিল সে বিষয়ে যথাযথ তদন্তপূর্বক দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ক্রয়কৃত সরঞ্জামের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক কমিশনকে অবহিত করতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে বলা হয়েছে। আগামী ৬ জুন প্রতিবেদনের জন্য ধার্য করা হয়েছে।