অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ

প্রকাশিত: ১:০৭ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ১৩, ২০২৫


সানজিদা মাহবুবা:

 

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রশ্নের মুখে পড়েছে ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ঐতিহ্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটিতে ঘটছে অর্থ তছরুপের ঘটনা। এ ক্ষেত্রে অভিযোগের মূল তীর রয়েছে বর্তমান অধ্যক্ষের দিকে। অধস্তন শিক্ষক-কর্মচারীরা আগে এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করলেও এখন বিষয়টি নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে বৈঠকেই সরব হচ্ছেন শিক্ষকরা। গত বুধবার শিক্ষকদের সঙ্গে জরুরি অভ্যন্তরীণ বৈঠকেও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও হট্টগোলের ঘটনা ঘটে।

বৈঠকে একজন শিক্ষক অধ্যক্ষের উদ্দেশে বলেন, ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবেন না। আপনার অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। এগুলো বন্ধ না করলে আপনাকে আমরা প্রিন্সিপাল হিসেবে মানব না।’ এ সময় অধ্যক্ষ বলেন, ‘আপনি একজন প্রিন্সিপালকে এই ধরনের কথা বলতে পারেন না। আপনাকে দেখে নেব।’ সেখানে একজন শিক্ষক বলেন, ‘প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকদের যে খাবার পরিবেশন করা হয় সেটা নিম্নমানের। দীর্ঘদিন ধরে এটা চলে এসেছে।’ তখন অধ্যক্ষ বলেন, “খাবার আমি নিজে খাই। খাবারের মান কী, আমি জানি। মান নিয়ে প্রশ্ন অযৌক্তিক। কোনো প্রশিক্ষাণার্থী মান নিয়ে প্রশ্ন করেননি।’ (এ সংক্রান্ত অডিও ইত্তেফাকের কাছে সংরক্ষিত আছে।)

জানা গেছে, গত ৯ জুলাই এই কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে পদায়ন পান অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানা । তখন থেকেই তিনি বিধিবহির্ভূতভাবে কলেজের বিজ্ঞান উন্নয়ন হোস্টেলের দ্বিতীয় তলায় দুটি কক্ষ নিয়ে নামমাত্র খরচে নিয়মিত বসবাস করে আসছেন। অথচ এই হোস্টেল মূলত প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকদের থাকার জন্য তৈরি করা হয়েছে। অধ্যক্ষের নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কোয়ার্টারে থাকছেন সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম ফারুক যিনি কিনা এক বছরের বেশি সময় আগেই অবসরে চলে গেছেন । সূত্রমতে, তার কাছ থেকে নিয়মিত ভাড়া নিচ্ছেন বর্তমান অধ্যক্ষ । এর আগে কুমিল্লায় সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অধ্যক্ষ থাকাকালে সেখানেও তিনি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের থাকার পাঁচটি কক্ষ দখলে নিয়ে দুই বছর বসবাস করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র ইত্তেফাককে জানিয়েছে, সম্প্রতি কলেজের মূল গেইট এবং বাউন্ডারি নির্মাণ কাজ অনুমোদনের জন্য ঠিকাদারের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেন অধ্যক্ষ। এছাড়া কলেজের অভ্যন্তরীণ প্রায় ৩৪টি কমিটির বরাদ্দকৃত টাকা থেকে একটা অংশ তাকে দিতে হয়। বাধ্য হয়ে কমিটির কর্মকর্তাগণ ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে হিসাব বিবরণী সমন্বয় করেন। তাতে স্বাক্ষর করেন অধ্যক্ষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের এক শীর্ষ কর্মকর্তা গতকাল রাতে ইত্তেফাককে বলেন, কলেজের ভিতরে ১৮ হাজার বর্গফুট জায়গায় টাইলস ফিটিংয়ের কাজ করানোর কথা। কিন্তু বাস্তবে প্রায় ৫ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে কাজ অসম্পন্ন রয়েছে। তিনি বলেন, এর নেপথ্যে অর্থ তছরুপের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া কলেজের পরিবহনের ভাউচারে বড় অঙ্কের টাকা তছরুপ হয়েছে ।

বিটিটি এবং এইচআইটি/এএইচআইটি প্রশিক্ষণ কোর্সে রিসোর্স পারসন হিসেবে নিজের নাম দিয়ে রাখেন অধ্যক্ষ। কিন্তু তিনি সেখানে ক্লাস নেন না । ক্লাস নেন অন্য কর্মকর্তারা। অথচ রিসোর্স পারসনের সম্মানীর টাকা অধ্যক্ষ নিয়ে নেন। যেটি দিনের পর দিন হয়ে আসছে। গত ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত একটি প্রশিক্ষণের ‘প্রশিক্ষক মূল্যায়ন ছকে’ও অধ্যক্ষের নামের বিপরীতে ‘শি হ্যাজ নট কনডাকটেড এনি সেশন’ উল্লেখ করা হয়েছে।

অভিযোগ আছে, কলেজে বিভিন্ন প্রকল্পের খাদ্য ব্যবস্থাপনায়ও অর্থ তছরুপের ঘটনা ঘটছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকদের জন্য সরবরাহকৃত খাদ্যের মানে। সর্বশেষ গত রমজানে ১০ মার্চ প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ চলাকালে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করায় সেই খাবার গ্রহণ করতে অ স্বীকৃতি জানিয়ে অধ্যক্ষ বরাবর লিখিতভাবে
অভিযোগ দেন তারা। একপর্যায়ে অধ্যক্ষ প্রতিটি কক্ষে গিয়ে প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চান এবং খাবারের মান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু এর পরও নিম্নমানের খাবার পরিবেশন অব্যাহত রাখায় প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের মধ্য থেকে খাবারের পরিবর্তে খাবারের জন্য বরাদ্দকৃত নগদ অর্থ দেওয়ার দাবি করা হয়। সূত্রমতে, সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে খাদ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ন্যস্ত থাকার নিয়ম থাকলেও অধ্যক্ষ নিজেই ‘ফুডিং” নামে খাদ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সরাসরি পরিচালনা করেন।

অভিযোগ মতে, কলেজে কর্মরত ৩০তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া এক শিক্ষক ‘বিশেষ আনুকূল্যের বিনিময়ে নানা সমালোচনামূলক কর্মকাণ্ডে অধ্যক্ষের সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। ইতিপূর্বে অধ্যাপক কানিজ সৈয়দা বিনতে সাবা এখানে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বপালন কালেও ৩০তম বিসিএসের ঐ শিক্ষক একই কায়দায় নানা অনিয়মে তার সহযোগী হিসেবে ভূমিকা রাখেন । যে বিষয়ে দুদকে মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এখনো তাকে এ নিয়ে দুদকে হাজিরা দিতে হয়।

এসব ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ অধ্যাপক রিজিয়া সুলতানা ইত্তেফাককে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ মিথ্যা। প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের হোস্টেলে তার বসবাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তার নামে বরাদ্দকৃত কোয়ার্টারে পিআরএলে যাওয়া সাবেক অধ্যক্ষ বসবাস করছেন। তিনি খুব অসুস্থ। তার পিআরএলের মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হবে। বিষয়টি মাউশির সংশ্লিষ্ট বিভাগ অবগত আছে। প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের থাকার স্থানে তিনি নিয়ম মেনে সিট ভাড়া দিয়ে থাকছেন। উন্নয়ন কাজের অনুমোদন পেতে ঠিকাদারের কাছ থেকে টাকা দাবির অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে তিনি বলেন, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ।

নিম্নমানের খাবার পরিবেশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রশিক্ষণ নিতে আসা শিক্ষকদের নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয়নি।

বুধবারের বৈঠকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনিই বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। তবে সেখানে কোনো উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের ঘটনা ঘটেনি।