অন্তর্র্বতী সরকারের প্রথম বাজেট তিন বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হচ্ছে বাজেট

সেলিনা আক্তার:
আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে। এটি হবে বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের প্রথম বাজেট। নতুন বাজেটে অগ্রাধিকার পাবে খাদ্য নিরাপত্তা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন। গুরুত্ব পাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর স্বার্থ। এর অংশ হিসেবে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রাথমিকভাবে ৮ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাজেটের আকার এমন ধরেই আয়-ব্যয়ের খসড়া রূপরেখা সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সামনে তুলে ধরেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
অর্থ উপদেষ্টার বাজেট বক্তব্যে অন্তর্ভুক্তির জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থায় চিঠি দিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য ও পরিসংখ্যান সংবলিত প্রতিবেদন আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়েছে। তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি বেগবান করার পদক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, বৈষম্য কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার, পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে বলা হয়। একই সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক অন্য যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।
গত সোমবার ‘উন্নয়ন ও বিশ্বায়ন: দৃশ্যপট আন্তর্জাতিক বাংলাদেশ’ বইয়ের উন্মোচন অনুষ্ঠানে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে হয়তো তেমন পরিবর্তন হবে না। কিন্তু আগামী বাজেটে ব্যাপক পরিবর্তন টের পাওয়া যাবে। তবে কী পরিবর্তন আসছে, তা বিস্তারিত বলেননি।
গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার সমকালকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিক কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার নতুন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশেষ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে হবে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কার প্রয়োজন। উচ্চ শুল্কের কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসে না, রপ্তানি পণ্যেও বৈচিত্র্য হয় না। তিনি আরও বলেন, এনবিআর এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার সংস্কার না করলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি থমকে দাঁড়াবে।
মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। আগামী অর্থবছর (২০২৫-২৬) শেষে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশ নামিয়ে আনতে চায় সরকার। তাই সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে না।
বাজেট তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এমন আলোচনা হয়েছে যে, খুব প্রয়োজন না পড়লে টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেওয়া বন্ধ রাখা হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর হ্রাস অব্যাহত রাখা হবে। একই সঙ্গে পণ্য সরবরাহ চেইনের সকল স্তরের প্রতিবন্ধকতা দূর করা হবে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নির্ধারণে অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি অনুবিভাগ গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আগামী মার্চ নাগাদ এ কার্যক্রম শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় পওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে কিছু উদ্যোগ আগামী বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
ভাতা ও সুবিধাভোগী বাড়ানোর উদ্যোগ
আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতার পরিমাণ ও সুবিধাভোগী বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাসহ প্রায় ১০টি ভাতা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা রয়েছে সরকারের। বয়স্ক, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা বাড়তে পারে। বর্তমানে সারাদেশে ৬০ লাখ বয়স্ক নাগরিককে মাসিক ৬০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়। মাসিক ৫৫০ টাকা করে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীকে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। আর ৩২ লাখ ৩৪ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পান ৮৫০ টাকা করে।
হিজড়া, বেদে, চা শ্রমিক ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভাতা দিচ্ছে সরকার। তাদের ভাতাও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচি ও ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব পাওয়ার পর আগামী এপ্রিল মাসের শুরুতে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে এ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় আলোচনার পর কোন খাতে ভাতা কত বাড়ানো হবে, সেই সিদ্ধান্ত হবে।
বর্তমানে ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪০টি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এ জন্য চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট ১ লাখ ৩৬ হাজার ২৬ টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা জাতীয় বাজেটের ১৭ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। অবশ্য এই বরাদ্দের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদের পেনশন সুবিধা বাবদ ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ সহায়তায় ৮ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা এবং ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি কেনা বাবদ ৩৪২ কোটি টাকা। তবে এসব খাতসহ আরও কিছু খাতকে প্রকৃত সামাজিক নিরাপত্তা নয় বলে অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাড়তি নজর
চলতি অর্থবছরে কয়েক দফা ভয়াবহ বন্যায় ফসলের ক্ষতি হওয়ায় আউশ এবং আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ১৩ লাখ টন কম হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মজুতও গত বছরের তুলনায় প্রায় ২৩ শতাংশ কম ছিল। তাই মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে চলতি অর্থবছর ৯ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয়ভাবে খাদ্যশস্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সে জন্য সারের মূল্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রয়েছে।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি ২১ হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী বাজেটেও এ খাতে বাড়তি বরাদ্দ অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্য ভর্তুকি বাবদ চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ৮ হাজার ৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মূলত ওএমএস, টিসিবি, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি সারা বছর চলমান রাখার লক্ষ্যে বর্ধিত হারে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী বাজেটে এসব খাতে বাড়তি বরাদ্দ রাখা হবে।
কর্মসংস্থান বাড়াতে যেসব উদ্যোগ
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানে ধীরগতি রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আগামী বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়ে থাকছে বিশেষ নজর। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা ৮ লাখ কোটি টাকার নিচে বাজেট দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ানোর বিষয়টি মাথায় নিয়ে বাজেটের আকার কিছুটা বড় করা হচ্ছে। কারণ সরকারি ব্যয় বেশি সংকুচিত করে ফেললে কর্মসংস্থান বাড়বে না। একই সঙ্গে সরকার ব্যয় মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ কম নেওয়া হবে। যাতে করে উদ্যোক্তাদের অর্থায়নে কোনো সমস্যা না হয়।