অর্থনীতির ভালো সূচকগুলো ধিরে ধিরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ছাড়া অর্থনীতির অন্তত ১৩টি সূচক এখন নিম্নমুখী। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ কারণে অধিকাংশ দুর্বল সূচক দিয়েই নতুন বছর শুরু হচ্ছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থনীতির প্রাণসঞ্চার করা সূচকগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান সূচকগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক খাতের পরিস্থিতি এত নাজুক, যে সরকারি একটি ব্যাংক তার কর্মকর্তাদের বেতন দিতে পারছে না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বেসরকারি খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাজস্ব আয় কমেছে, কমেছে রফতানি আয়ও, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। এছাড়া ভেঙে পড়ার অবস্থায় রয়েছে আমদানি বাণিজ্য, কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি, বেহাল দশায় পড়েছে পুঁজিবাজার, ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। চাপে পড়েছে ব্যাংক খাত, বন্ধ হচ্ছে গার্মেন্টস, সংকুচিত হচ্ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। মানুষের আয় না বাড়লেও মূল্যস্ফীতি তথা জিনিসপত্রের মূল্য বেড়েছে। বেড়েছে সরকারের ব্যাংক ঋণ, বেড়ে গেছে ব্যাংক ঋণের সুদ হার, বেড়েছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও। বাড়ছে ঋণ পুনঃতফসিলের ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশের অর্থনীতি এখন চাপের মধ্যে পড়েছে। অর্থনীতির অধিকাংশ সূচকই এখন দুর্বল। এই দুর্বল সূচক দিয়েই শুরু হচ্ছে নতুন বছর।
তিনি উল্লেখ করেন, সত্যিই সংকটের মুখে পড়েছে আমাদের অর্থনীতি। অর্থনীতির স্বাস্থ্য এখন খুবই দুর্বল। দিন যত যাচ্ছে, দুর্বলতা ততই বাড়ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
চাপে ব্যাংক খাত:
অন্য যেকোনও সময়ের চেয়ে ব্যাংক খাত এখন বেশ চাপে রয়েছে। ভালো ব্যাংকগুলোর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। গতিশীল ব্যাংক, খেলাপির কবলে পড়ে গতি হারাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের ঝুঁকিতে পড়েছে ৪০টি ব্যাংক। কোনও কোনও ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ব্যাংক খাত কতটা খারাপ হয়েছে, তার প্রমাণ মেলে সরকারি বেসিক ব্যাংকের দিকে তাকালে। ২০০৯ সালের আগে সরকারি খাতে ‘মডেল ব্যাংক’ মনে করা হতো এই ব্যাংকটিকে। তখন প্রতিবছর মুনাফা বেশি করায় ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনও ছিল অন্য ব্যাংকের চেয়ে বেশি। কিন্তু এখন ভয়ানক পরিস্থিতি বিরাজ করছে ব্যাংকটিতে। পরিস্থিতি এত নাজুক, যে ব্যাংকটি তার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। এ অবস্থায় ব্যাংকটির সব কর্মকর্তার বেতন কমিয়ে গত ২২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি জারি করা হয়। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিগত সাত বছর লোকসান হওয়ায় আগের মতো বেতন দেওয়া সম্ভব হবে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, শুধু বেসিক ব্যাংকই নয়, এখন সব ব্যাংকের অবস্থা প্রায় একই রকম। তবে বেসিক ব্যাংকের নাজুক অবস্থার জন্য তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকে এক সময় সুশাসন ছিল। কিন্তু শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকটাকে নষ্ট করা হয়েছে।
বেহাল দশায় পুঁজিবাজার:
ব্যাংক খাতের চেয়ে পুঁজিবাজারের অবস্থা আরও করুণ। ২০১০ সালের ধসের পর নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। গত কয়েক মাস ধরে দেশের পুঁজিবাজারে ক্রমাগতভাবে দরপতন চলছে। পতনের কারণে ক্রেতা হারিয়েছে এই বাজার। আর ক্রেতা না থাকায় লেনদেন তলানিতে নেমে এসেছে। তালিকাভুক্ত কোম্পানির এক চতুর্থাংশের দাম অভিহিত মূল্যের (ফেইস ভ্যালু, ১ টাকা) নিচে নেমে এসেছে। বেশ কিছু কোম্পানির দর ৫ টাকার কম।
ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত:
গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে বেসরকারি খাতে ঋণের হার কমছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের হার কমেছে প্রায় দশমিক ৬২ শতাংশ। অক্টোবরে ১০ দশমিক ৪ শতাংশ ছিল ব্যাংক ঋণের হার। এই হার গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক মাস ধরে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে ঋণ প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। যা আগের মাস, সেপ্টেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
বেড়ে গেছে ব্যাংক ঋণের সুদ হার:
উৎপাদন খাতে ৯ শতাংশ সুদ বেঁধে দেওয়া হলেও ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েই চলেছে। অনেক ব্যাংক আবার ঘোষণা দিয়েই ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ হারে সুদ আরোপ করছে। ঋণ ও আমানতের গড় সুদহারের ব্যবধান ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার নির্দেশনা থাকলেও সেটিও মানছে না ব্যাংকগুলো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে অধিকাংশই এখনও দুই অঙ্কের সুদ নিচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় উৎপাদনশীল খাতের ব্যাংক ঋণে এক অঙ্কের সুদ হার অনুমোদন করা হয়েছে। এই সুবিধা পাবে শিল্পখাতের মেয়াদি এবং তলবি ঋণের গ্রাহকরা। দেশের সার্বিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পর্ষদ সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ:
বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তবে, ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। কারণ, অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণ আদায় করতে পারছে না। আবার ওই ঋণগুলোকে খেলাপি হিসেবেও চিহ্নিত করছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত ৯ মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা (অবলোপন ছাড়া)।
বাড়ছে ঋণ পুনঃতফসিলের ঘটনা:
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়লেও আদায় বাড়ছে না। এ কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ পুনঃতফসিল নীতি গ্রহণ করেছে। এতে কাগজে খেলাপির পরিমাণ কম দেখালেও ব্যাংক খাতে ধীরে ধীরে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার ঋণ পুনঃতফসিল হয়েছে। বছর শেষে তা ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও ২০১৮ সালের পুরো বছরে ২৩ হাজার ২১০ কোটি টাকার ঋণ নিয়মিত হয়েছিল, ২০১৭ সালে যা ছিল ১৯ হাজার ১২০ কোটি টাকা।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এখন প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত ফাইল ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য পাঠানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা নিজে গিয়ে তদবির করছেন, আবার ওপর মহল থেকেও তদবির করাচ্ছেন। যার তদবির যত শক্তিশালী হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ তাকে সেভাবেই সুবিধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নীতিমালার বাইরে এসব ঋণ পুনঃতফসিলের দায় কোনও কর্মকর্তা নিতে চাইছেন না, ফলে প্রতিটি ফাইলে গভর্নরের অনুমোদন লাগছে। এর ফলে ব্যাংকিং নীতি বিভাগটি হয়ে পড়েছে পুরোপুরি ঋণ পুনঃতফসিল বিভাগ। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন হয়ে উঠেছে ঋণ পুনঃতফসিল কেন্দ্র।
কমেছে রফতানি আয়:
টানা চার মাস ধরে রফতানি আয় কমেছে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইতে রফতানি আয় ইতিবাচক হলেও সর্বশেষ মাস নভেম্বরে রফতানি আয় কমেছে ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত বছরের নভেম্বরে রফতানি আয় হয়েছিল ৩৪২ কোটি ১৯ লাখ ডলার। এই বছরের নভেম্বরে রফতানি আয় হয়েছে ৩০৫ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম পাঁচ মাসে রফতানি আয় হয়েছে এক হাজার ৫৭৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম।
আগামী দিনগুলোতেও একই পরিস্থিতি থাকতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন খোদ বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক। তিনি পরিস্থিতিকে খুবই খারাপ উল্লেখ করে বলেন, দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে। রফতানি খাতে সরকারের পলিসি সাপোর্ট জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বন্ধ হচ্ছে গার্মেন্টস:
গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা বলছেন, তৈরি পোশাক খাতে চলমান সংকট রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিজিএমএর তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে আর্থিক সমস্যার কারণে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৬০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চাকরি হারিয়েছেন ২৯ হাজার ৫৯৪ জন শ্রমিক। এদিকে ইপিবির তথ্য বলছে, গত পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক রফতানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে এক হাজার ৩০৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেন, আমাদের সব অর্ডার ভিয়েতনাম-ভারতে চলে যাচ্ছে। এ কারণে এই মুহূর্তে গার্মেন্টস সেক্টরের প্রতি সরকারের নেক নজর জরুরি। এই বিপর্যয় থেকে উত্তরণে ২৫ শতাংশ স্থানীয় মূল্যসংযোজনের ওপর ডলারপ্রতি পাঁচ টাকা অতিরিক্ত বিনিময় হার আমরা চাই।
রাজস্ব আয় কমেছে:
অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে সরকারের আর্থিক জোগানদাতা রাজস্ব খাত অনেকটা স্থবির। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্ট থেকে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি কমছে। ওই মাসে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে নেগেটিভ। শুধু তাই নয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, জুলাই থেকে অক্টোবরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আয়ের প্রধান তিন খাতেই আদায় কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, গত আগস্টে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাইনাস ৫ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০১৮ সালের আগস্টে রাজস্ব আয় হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৪৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের আগস্টে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৪ হাজার ১৮৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত বছরের আগস্টের চেয়ে এই বছরের আগস্টে রাজস্ব আয় কমেছে ৭৫৮ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আয় হয়েছে ১৭ হাজার ৭৮৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। পরের মাস অক্টোবরে আয় হয়েছে ১৭ হাজার ৬৭৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে রাজস্ব আয় কমেছে প্রায় ১০৯ কোটি টাকা।
কমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ:
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৭ সালে ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। এই বছরের জুনেও ৩৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। কিন্তু এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ৩২ বিলিয়ন ডলার। আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে রিজার্ভ বৃদ্ধির গতি থেমে গেছে।
ভেঙে পড়ার অবস্থায় আমদানি বাণিজ্য:
বেশ কিছুদিন ধরে আমদানিতে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে এই বছরের অক্টোবরে আমদানি বাণিজ্যে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৪ শতাংশ। আর চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ৩ দশমিক ১৭ শতাংশ । এর অর্থ হল, দেশের মানুষের ভোগ ব্যয় কমেছে এবং নতুন শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, এই চার মাসে শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। জ্বালানি তেল আমদানি কমেছে ১৫ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ।
কমে গেছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি:
গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১৭ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমতে কমতে চলতি বছরের অক্টোবরে মাত্র ৮২২ কোটি টাকায় ঠেকেছে। একক মাস হিসেবে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির এই হিসাব সবচেয়ে কম। অথচ আগের বছরের (২০১৮) একই মাসে যা ছিল ৪ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই ধারাবাহিক ভাটায় অর্থনীতিতে স্থবিরতার আশঙ্কা করেছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু কঠিন নিয়ম-কানুন জারি করা হয়েছে। এতে যারা সঞ্চয় করার সুযোগ পেতো, তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার সঞ্চয়পত্রে কড়াকড়ির ফলে ব্যাংক খাতেও উন্নতি হচ্ছে না। অবশ্য সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার কথা ২৭ হাজার কোটি টাকা।
ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি:
গত এক বছরে বেড়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়। অথচ ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। এই হিসাবে গত এক বছরে পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে পাঁচশ ভাগের বেশি। এদিকে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) নভেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ। যদিও চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে বেঁধে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। অক্টোবরের ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ থেকে নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির প্রধান কারণ পেঁয়াজ। নভেম্বরে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত বছরের একই মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ।
বেড়েছে সরকারের ব্যাংক ঋণ:
২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ নেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু ছয় মাস না যেতেই সরকার ৪৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা ধার হিসেবে নিয়েছে। সাধারণত অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের টাকার টান পড়ে বেশি। কিন্তু এবার অর্থবছরের শুরুতেই টাকার টান পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বেসরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যে পরিমাণ ঋণ পাচ্ছে, সরকার ঋণ পাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। গত ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের কাছে পাবে এক লাখ ১০ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাবে ৪১ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।
ইতিবাচক ধারায় রেমিটেন্স প্রবাহ:
অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত গতিশীল রয়েছে রেমিটেন্স প্রবাহ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা তাদের উপার্জিত টাকা দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখছেন। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রেমিটেন্স এসেছে ৭৭১ কোটি (৭.৭১ বিলিয়ন) ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি। এই ধারা অব্যাহত থাকলেও অন্য সূচকগুলো নিম্নমুখী হওয়ায় অর্থনীতির জন্য সামনে খারাপ সময় অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র বাংলাট্রিবিউন।