নিজস্ব প্রতিনিধি:
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। পালিয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, মাহবুব উল-আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ সম্পাদক পদের নেতারা। এ অবস্থায় নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে টানা সাড়ে ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকা দলটি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে তাদের ছেলে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ কি একই কাজ করবেন? কী ভাবছেন তিনি?
এ প্রশ্নের উত্তরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়েছেন শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ। এ নিয়ে শনিবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে বাংলা একাডেমির আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে ‘শতাব্দীর কণ্ঠস্বর তাজউদ্দীন আহমদ, কন্যার চোখে পুত্রের চোখে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন সোহেল তাজ।
সোহেল তাজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের দায়িত্ব তখনই নেওয়ার প্রশ্ন আসবে, আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে যখন আত্মসমালোচনা করবে এবং আত্মোপলব্ধি করবে, তাদের কর্মকাণ্ডগুলো স্বীকার করবে এবং যারা আওয়ামী লীগকে এই পথে নেতৃত্ব দিয়ে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছে তাদেরকে জবাবদিহি করবে, যারা হত্যা, খুন, গুমের সাথে জড়িত, দুর্নীতির সাথে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তি দেবে এবং আওয়ামী লীগ যখন ক্লিন হবে, তারপরে যদি তারা চায় নেতৃত্ব, দেন আমি বিবেচনা করব।’
যে কারণে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সোহেল তাজ। ২০০৮ সালে একই আসন থেকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সোহেল তাজ। তবে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে একই বছরের ৩১ মে মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। সে সময় তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না হলেও একই বছর ৭ জুলাই তিনি আবার পদত্যাগপত্র দিলে সেটি গ্রহণ করা হয়। এই পদত্যাগের কারণ নিয়ে শনিবার কথা বলেন সোহেল তাজ।
সোহেল তাজ বলেন, ‘আপনি যে হাতিয়ারকে ব্যবহার করবেন দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে, সেই হাতিয়ারই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয় তাহলে আপনি কিন্তু কোনোদিনই কামিয়াব হবেন না আপনার উদ্দেশ্যে। আমি খুব উৎসাহ-উদ্দীপনা, ইন্সপিয়ারেশন-ইন্সপায়ার্ড হয়ে সে কাজে হাত দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে ছয় মাসের ভেতর প্রতীয়মান হয় যে আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমরা জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। এটার অনেকগুলো কারণ আছে। কারণ মর্নিং শোজ দ্যা ডে। আমরা যদি আসলেই সেই কাজগুলো করতাম, তাহলে প্রথম সপ্তাহ থেকে আমরা পদক্ষেপ দেখতে পারতাম।’
সোহেল তাজ বলেন, ‘আমি যখন পদক্ষেপ নিতে চেয়েছি, আমাকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। আমি পুলিশে সংস্কার করতে চেয়েছিলাম, বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলাম। দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলাম, বাধাগ্রস্ত হয়েছি। অনিয়মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলাম, বাধাগ্রস্ত হয়েছি। আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। আমি নিজেকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে এই মন্ত্রীর মসনদে বসে থাকতে চাইনি। আমার প্রতিবাদের ভাষা ছিল পদত্যাগ। বাংলাদেশের ইতিহাসে পদত্যাগ কেউ করে না। আমি ভেবেছিলাম আমার পদত্যাগের মাধ্যমে আমি একটি ক্লিয়ার মেসেজ দিব যে আমি এটা মেনে নেইনি।’
৫ আগস্ট, আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন সোহেল তাজ
সোহেল তাজ বলেন, ‘আমি মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছিলাম এই ধারাবাহিকতা যদি কন্টিনিউ করে ৫ই আগস্টের মতো একটি ঘটনা ঘটবে। আমরা দেখেছি ২০১৪ এর নির্বাচন। আমি একটা কথা বারবার বলেছিলাম, দলীয় ফোরামে যতটুকু পেরেছি, ক্যাবিনেট মিটিংয়ে আমি বারবার বলেছিলাম, আমরা যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারি, ডোন্ট ওয়ারি অ্যাবাউট ভোটস। জনগণ ভোট দেবে, না দেবে সেটা আমরা চিন্তা করব না। আমরা সঠিক কাজটি করে যাই। পরের নির্বাচন যদি হেরেও যাই তার পরের বার কিন্তু মানুষ ফুল দিয়ে নিয়ে আসবে। এই বিশ্বাস আমার ছিল। কিন্তু আমরা সেই পথে না গিয়ে ক্ষমতা না হারানোর পথটা বেছে নিয়েছি। আমরা গণতন্ত্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, দেশের মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।’
সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই জুলাই-আগস্ট মাসে যে গণঅভ্যুত্থান, এই গণঅভ্যুত্থানে যেভাবে গণহত্যা করা হয়েছে এবং তার পূর্ববর্তী ১৫ বছর অনিয়ম, দুর্নীতি, হত্যা, গুম, নির্যাতন এবং জনমানুষ, রাজনীতির প্রতিপক্ষকে নির্যাতন-নিপীড়ন করা হয়েছে সেটা তো গণতন্ত্র না, সেজন্য তো আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ না। এই জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে যেটা আমরা বাংলাদেশের সকল জনগণের সাথে উইটনেস করেছি সেটা গণহত্যা। ইয়াং ছেলে-মেয়েসহ হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা, তার পরে আমাদের ভেতরে যদি ন্যূনতম বিবেক থাকে, এটাকে তো সমর্থন কোনোদিনই করা সম্ভব না।’
ঐতিহ্য প্রকাশনী আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে শারমিন আহমেদের লেখা ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা’ বইটি পূর্বের তুলনায় কমমূল্যে নতুন সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ঐতিহ্যর প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান নাইম সোহেল তাজ ও শারমিন আহমেদের হাতে বইয়ের নতুন সংস্করণের কপি হাতে তুলে দেন।
তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমেদ বলেন, তরুণরা যদি মানুষের সেবা করতে সামনে এগিয়ে যেতে চায় তাহলে আমরা পাশে আছি। কিন্তু এই মুহূর্তে একেবারে সরাসরি রাজনৈতিক দল করার চিন্তাভাবনা নেই। বড় রাজনীতি হলো মানুষের সেবা করা। আমরা মানুষের সেবা দিচ্ছি।
তরুণ প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধান করার আহ্বান জানিয়ে শারমিন আহমেদ বলেন, দেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দাঁড় করানো হয়েছে একটি পিলারের (স্তম্ভ) ওপর; ‘বঙ্গবন্ধু পিলারের’ ওপর। এখানে অনেক মানুষের অবদান হারিয়ে গেছে; বিশেষ করে গ্রামবাংলার তরুণ, কিশোর, বীরাঙ্গনা—তাদের কাহিনিগুলো।
তিনি বলেন, ১ টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর ছবি, ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০ টাকার নোটেও বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা নয়, এটা হয়ে যায় এক ব্যক্তির ইতিহাস।