বিনোদন ডেস্ক:
দ্বন্দ্ব-সংঘাতের গল্প বলতে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংগ্রাম শুরু করেছিলেন প্রখ্যাত নির্মাতা তারেক মাসুদ। তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার বাইরে গিয়ে সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষের গল্প। তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে রুপালি পর্দায় তুলে এনেছেন সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় নানা অসংগতি। বলা চলে, স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন তারেক মাসুদ।
গুণী এই নির্মাতা নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তার প্রথম সিনেমা ‘মাটির ময়না’য়। সিনেমাটিকে অনেকেই তার আংশিক বায়োগ্রাফি বলে থাকেন। যে জীবনের গল্প বলার স্বপ্ন নিয়ে তিনি সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন, সেই গল্প তিনি নিয়ে আসেন চলচ্চিত্রে। মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে তার যে বিচিত্র রকমের অভিজ্ঞতা, তা আনু চরিত্রে গল্প আকারে সিনেমায় তুলে ধরেন।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল-এই সিনেমাটি শুধু তাকে নয় বিশ্বের বুকে বাংলা সিনেমাকে চিনিয়েছিল। কান উৎসবের ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল সিনেমাটি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি এলিয়া সুলেমানের ডিভাইন ইন্টারভেনশন সিনেমার সঙ্গে যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কার লাভ করে।
এছাড়াও মাটির ময়না বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। মাটির ময়নার পর তিনি নির্মাণ করেন বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল ছবি ‘অন্তর্যাত্রা’। এতে বিশ্বায়নের এ সময়ে জাতীয়তাবোধের টানাপোড়েন নিয়ে অভিবাসী মানুষের সাময়িক যন্ত্রণার গল্প তুলে ধরেন। সিনেমাটিতে সেই সময়ের বাস্তব প্রেক্ষাপট উঠে আসায় দর্শক-সমালোচক মহলে দারুণ সাড়া ফেলে। তবে এমন সাফল্যেই থেমে থাকেননি এই নির্মাতা।
এরপর তারেক মাসুদ নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘রানওয়ে’। এই সিনেমাতেও তিনি জাতীয় জীবনের সাধারণ এক দরিদ্র পরিবারের নানা দিক নিখুঁতভাবে তুলে ধরেন। এই সিনেমাটিও সর্বমহলে প্রশংসা কুড়ায়। এছাড়াও তার ‘মুক্তির কথা’, ‘নারীর কথা’, ‘নরসুন্দর’ সিনেমাগুলোতে সমাজের নানা অসংগতি আর বাস্তবতার গল্প তুলে ধরেন। যা তৎকালীন সমাজে দারুণ সমাদৃত হয়।
শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে তিনি ‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন। ‘মুক্তির গান’ তৈরিতে তখনকার সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করে সব ফুটেজ একত্র করা অন্যতম এক চ্যালেঞ্জের কাজ ছিল। প্রামাণ্যচিত্রটি তখনকার যুব সমাজ নয়, নতুন প্রজন্মের জন্যও এক অনন্য দলিল হয়ে আছে। এই প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য তিনি ১৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রের পুরস্কার লাভ করেন। উল্লেখ্য, তারেক মাসুদ তার নির্মাণে যে বাস্তব আর জীবনমুখী ধারার সূচনা করে গেছেন তা আজও দেশের স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে পাথেয়। আজও তাকে স্মরণ করে চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজনের পাশাপাশি তার নির্মাণকে অনুসরণ করেন দেশের নির্মাতারা। তুলে ধরতে চান সমাজ ও দেশের নানা সংগতি-অসংগতি। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটেও যা খুবই প্রাসঙ্গিক।
গতকাল ছিল গুণী এই নির্মাতার বেদনাবিধুর প্রয়াণ দিবস। তারেক মাসুদ ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ‘কাগজের ফুল’ নামে একটি চলচ্চিত্র তৈরির জন্য শুটিংস্পট খুঁজতে গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জের ইছামতী নদীর তীরে। সেখান থেকে ফিরছিলেন বন্ধু মিশুক মুনীর ও স্ত্রী ক্যাথরিনের সঙ্গে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঘিওরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় এ সিনেমার ফেরিওয়ালার জীবন।