ডেস্ক রিপোর্ট :
‘৪৫ বছর আমরা কষ্টে কাটিয়েছি। মুখ বুজে সহ্য করেছি। কবে এই আলবদরদের শাস্তি হবে। যে নৃশংসভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে—তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। চোখের চিকিৎসকের চোখ তুলে নেওয়া, হৃদরোগের চিকিৎসকের হার্ট খুবলে নেওয়া, এসব যারা দেখেননি—তারা বিশ্বাসও করতে পারবেন না।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় শহীদ চিকিৎসক আলীম চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী এসব কথা জানিয়েছিলেন।
যুদ্ধের পুরো ৯ মাসজুড়ে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হলেও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় দিবসের দিনকয়েক আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার সহযোগীদের শেষ আঘাতটি ছিল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা ধরে হত্যাকাণ্ড। গবেষকরা বলছেন, এই হত্যার সংখ্যা ১৮ বা ১৯—যেটাই বলা হোক না কেন, যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা সংখ্যা দিয়ে বিচারের না।
সেদিন যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন, তাদের তালিকায় ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী এবং সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা। হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল আলবদর বাহিনী। ১৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে একযোগে অনেক বুদ্ধিজীবীকে তাদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়।
কেবল আজকের দিনেই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল তা নয়, ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে দেশজুড়ে হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজের পাশাপাশি বাছাই করে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের নিধন-পর্বও চলছিল প্রায় প্রতিদিনই, এমনকি বিজয়ের পরেও। স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো ৯ মাসই সুপরিকল্পিতভাবে একের পর এক বুদ্ধিজীবী হত্যা চলতে থাকে। পাকিস্তানি ঘাতকদের আত্মসমর্পণের ঠিক দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বরের বীভৎস-নারকীয়-পাশবিক হত্যাকাণ্ড ছিল ইতিহাসে এক জঘন্য বর্বর ঘটনা।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ ঢাকায় নতুন করে কারফিউ জারির পর ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রস্তুতি নেওয়া হতে থাকে। মূলত ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পনার মূল অংশ বাস্তবায়ন করা হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, লেখকসহ চিহ্নিত দু’শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসররা জোরপূর্বক অপহরণ ও নির্যাতনের পর হত্যা করে বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়।
ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো ৯ মাস ধরে যে বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছিল, তার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা রাও ফরমান আলী। বাস্তবতা হলো, তাদের বিচার সম্পন্ন করা যায়নি। এবং পরবর্তীকালে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর রাও ফরমান আলীর একটি ডায়েরি পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশের অনেক বুদ্ধিজীবীর নাম লেখা ছিল।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী’দের সংজ্ঞা চূড়ান্ত করা হয়। সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত সময়কালে যেসব বাঙালি সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন এবং এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কিংবা তাদের সহযোগীদের হাতে শহীদ কিংবা ওই সময়ে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছেন—তারা শহীদ বুদ্ধিজীবী।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. মুনীর চৌধুরী, ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. সিরাজুল হক খান, ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী, হুমায়ুন কবীর, রাশিদুল হাসান, সাজিদুল হাসান, ফজলুর রহমান খান, এন এম মনিরুজ্জামান এ মুকতাদির, শরাফত আলী, এ আর কে খাদেম, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, এম এ সাদেক, এম সাদত আলী, সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, এম মর্তুজা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. হবিবুর রহমান, ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার ও মীর আবদুল কাইউম।
চিকিৎসকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি, অধ্যাপক ডা. আব্দুল আলিম চৌধুরী, অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়শা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক, ডা. মোহাম্মদ শফী। সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন—শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, সিরাজুদ্দীন হোসেন, আ ন ম গোলাম মুস্তফা। গীতিকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সমাজসেবক এবং দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহা (আরপি সাহা), শিক্ষাবিদ আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক যোগেশ চন্দ্র ঘোষ, লেখক, কবি মেহেরুন্নেসা, শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ ড. আবুল কালাম আজাদ, আইনজীবী নজমুল হক সরকার ও সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক নূতন চন্দ্র সিংহ। এ ছাড়া বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে ১৬ ডিসেম্বরের পর শহীদ হন চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘গণহত্যার পরিকল্পনা তারা শুরু থেকেই করেছিল। বাংলাদেশি দোসরদের সহায়তায় তারা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করেছিল। পরাজয় মেনে নিতে না পেরে, জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গা একদম শূন্য করে দেওয়ার জন্যই এই নীলনকশা করেছিল তারা। জেনোসাইড ওয়ার ক্রাইম ও ম্যাস রেপের (যুদ্ধকালীন গণহত্যা ও গণধর্ষণ) কোনও ক্ষমা নেই। পাকিস্তানের দোসরদের সঙ্গে পাকিস্তানিদের বিচারও শুরু করতে হবে।’