গত রাতে তিনজন ‘মডেল-অভিনেত্রী’র বাসায় অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ বিপুল পরিমাণ মাদকসহ তাদের আটক করেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। মডেল-অভিনেত্রীদের এমন কাণ্ডে বিস্মিত সাধারণ মানুষ! লজ্জা-অপমানে মুখে কুলুপ এঁটেছেন শোবিজ অঙ্গনের মানুষেরা। তাদের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন- এরা সত্যি মডেল বা অভিনেত্রী কিনা?
মিডিয়ার মানুষগুলো স্বীকার করুক বা না-করুক সংবাদমাধ্যম আর পুলিশের বক্তব্যে তারা মডেল বা অভিনেত্রী। এখন প্রশ্ন হলো- আদৌ কি তারা প্রফেশনাল মডেল বা অভিনত্রী? যদি তা না হয়, বা অনেক আগে এ পেশার সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন আর এ পেশায় তাদের দেখা যায় না- তাহলে এখনও কেন তারা সেই পরিচয় বহন করবেন? এখন তারা যে পেশায় রয়েছেন তারা সেই পরিচয়ে পরিচিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা উল্টোটা দেখছি। কেন দেখছি এর উত্তর সহজ। শোবিজ অঙ্গনের মানুষ হলে একটু বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। যে কারণে তারা সেই পরিচয় আকড়ে থাকেন।
পর্দায় সিনেমা বা নাটক দেখে কিংবা রাস্তায় সুদর্শন তরুণীর ছবি বিলবোর্ডে দেখেও অনেকে প্রেমে পড়েন। কেউ গ্ল্যামার দেখেন, কেউ স্টাইলে মুগ্ধ হন। অনেকেই ভাবেন বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের মতো মনটাও হয়তো তার সুন্দর। স্বাভাবিক কারণে তাদের প্রতি আগ্রহও একটু বেশি। আর এই সুযোগ নিতেই মডেল-অভিনেত্রী তকমা সেঁটে দেয়া হয়। এদের অধিকাংশই মডেল বা অভিনেত্রী নয়। দু’একটা বিছিন্ন ঘটনা থাকতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে অনেকই মডেল, অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা বনে যান। ফেইসবুক খুললেই অনেক মেয়ের ছবিতে চোখ আটকে যায়। বিভিন্ন স্টাইলে, নানা রঙ-বেরঙের পোশাক পরে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। শুধু তাই নয়, আরো রূপবতী দেখাতে এসব ছবি তারা সম্পাদনা করতেও পিছপা হন না। কেউ কেউ আবার দ্রুত আলোচনায় আসতে অশ্লীল ভঙ্গি ও পোশাক পরে ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেন। এসব ছবি ও ভিডিওতে ‘দুষ্টু ছেলের দল’ হাজারো কমেন্টস করে। এতে আরো উচ্ছ্বসিত হন ছবি বা ভিডিও প্রকাশকারী। দেখা যায়, এদের প্রত্যেকেই ফেইসবুক আইডিতে অ্যাকট্রেস, ফিল্ম আর্টিস্ট, হিরোইন ইত্যাদি লিখে রাখেন। অথচ আদৌ এরা কোনোদিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন কিনা সন্দেহ! তারা ভুলে যান ফেইসবুকে ছবি পোস্ট করে নায়িকা হওয়া যায় না। শাবানা, ববিতা, মৌসুমী, শাবনূর ফেইসবুকে ছবি পোস্ট করে নায়িকা হননি। নায়িকা হতে হলে কোয়ালিটি থাকা প্রয়োজন।
ফেইসবুক কাঁপানো এসব রমণীদের মধ্যে কেউ কেউ একটি–দুটি সিনেমার মহরত করেই নায়িকা বনে যান। বলা চলে ‘মহরত নায়িকা’। মহরত করেই সিনেমা শেষ। বছরের পর বছর পার হয়ে গেলেও তাদের সিনেমার শুটিং হয় না। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায়, নায়িকা নিয়ে আউটডোরে গিয়ে কয়েক দিনের শুটিং করেই শেষ। সিনেমা আর মুক্তি পায় না। পাবে কীভাবে? শুটিংই তো শেষ হয় না। অথচ জিজ্ঞেস করলেই মুখস্থ বলে দেন- শুটিং হচ্ছে। খবর নিয়ে জানা গেছে, এসব সিনেমার শুটিং আর হবে না। কিন্তু এসব সিনেমার নায়িকা চরিত্রে যাদের নেয়া হয় তারা সিনেমার কাজ না করলেও নিজেরা ঠিকই ‘নায়িকা’ পরিচয় দেন। বাস্তব জীবনেও তাদের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সিনেমার মহরতের আগে তারা রিকশা অথবা সিএনজিতে বিএফডিসিতে আসেন। এরপর তারা দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ান। নায়িকা তকমা লাগিয়ে দুদিন পরপর বিদেশ ভ্রমণ করেন। কোনো কাজ না করেই এত টাকা কোথায় পান তকমা লাগানো এই নায়িকারা?
কিছুদিন পরপর তকমা লাগানো নায়িকারা ফেইসবুক লাইভে এসে কু-রুচিপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি করে শরীর প্রদর্শন করেন। অনেকেই এসব দেখে ছি ছি করেন। এ ধরনের ফেইসবুক কাঁপানো নায়িকারা চলচ্চিত্র অঙ্গনের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে মিটিং করেন। এমনকি চলচ্চিত্রের অনুষ্ঠানগুলোতেও তারা জনপ্রিয় শিল্পীদের সঙ্গে সেলফি তুলে পরে ফেইসবুকে পোস্ট দেন। স্বাভাবিক কারণেই বিদেশি বন্ধু ও দেশের কোটিপতি বন্ধুরা ধারণা করেন- এরা চলচ্চিত্রের নায়িকা। আর এই তকমা নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ান আর বিভিন্ন অবৈধ সুবিধা ভোগ করেন। সমাজের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও অনেককে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তখন এরাই খবরের শিরোনাম হন- মডেল-অভিনেত্রী আটক। এতে শোবিজ অঙ্গনের বদনাম হয়। স্বাভাবিক কারণে খারাপ একটা মনোভাব তৈরি হয় এই অঙ্গনের মানুষদের নিয়ে।
সদ্য আটক হওয়া তিন মডেল-অভিনেত্রীর নামে গুগলে সার্চ দিলে চলে আসে বিগত দিনে তাদের অপকর্মের ফিরিস্তি। তারা কোন ব্র্যান্ডের মডেলিং করেছেন বা কোন নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করেছেন তার কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। একজন মডেল বা অভিনেত্রীর কাজ নিয়ে কিছু না কিছু খবর প্রকাশ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের তেমন কিছু চোখে পড়েনি।
এখানে আর একটি বিষয় পরিষ্কার নয়। কয়টি ব্র্যান্ডের মডেল বা নাটক করলে মডেল বা অভিনেত্রী হওয়া যাবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। যে কারণে একটি, দুটি ব্র্যান্ডের মডেল হয়েই অনলাইনে প্রকাশ করে মডেল বনে যাচ্ছেন অনেকে। আবার মোবাইলে শুট করে শর্টফিল্ম তৈরি করে ইউটিউবে প্রকাশ করে অভিনেত্রী বনে যাচ্ছেন অনেকে। এ ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। স্বঘোষিত এসব অপরাধীদের ‘মডেল বা অভিনেত্রী’ বলে খবর প্রকাশে সচেতন হওয়া উচিত।