আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কোমরতাঁত

প্রকাশিত: ১২:৪২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৫, ২০২৫


নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

আধুনিকতার স্রোত ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দিন-দিন হারিয়ে যাচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত শিল্প। অবশ্য এই ঐতিহ্য বিলুপ্ত হওয়ার পিছনে এই শিল্পে ব্যবহৃত বনজ সরঞ্জাম ও কাঁচামালের দুষ্প্রাপ্যতাকেও দায়ী করছেন এই কাজে সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরা।

শীতের সকালে বাড়ির উঠানে সোনালী রোদে কোমর তাঁতে পরিবারের প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় বুনতেন নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা। এক সময় প্রায় প্রতিটি পাহাড়ি বাড়ির উঠানে কাপড় বুনার এ দৃশ্য দেখা যেতো। কাপড় বুনতে-বুনতে চলতো পড়শি কিংবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আড্ডা। দুর্গম পল্লীর কোন কোন বাড়িতে চোখে পড়লেও শহুরে বসতিতে এখন এমন দৃশ্যের দেখা পাওয়া বিরল।

জুমে উৎপাদিত কার্পাস তুলায় চরকায় তৈরি করা সুতা বুনো গাছ-গাছালির কস বা রস ব্যবহার করে বিভিন্ন রঙে রঙিন করা হতো। আর বিশেষজাতের বনজগাছের কাঠ ও বাঁশের তৈরি সরঞ্জাম দিয়ে রঙিন সুতায় বোনা হয় কাপড়-চোপড়। কোমরে বেঁধে কাঠ ও বাঁশের সরঞ্জামে কাপড় বোনা হয় বলে এর নাম কোমর তাঁত।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর সকল সম্প্রদায়ই কোমর তাঁতে পরিবারের বস্ত্র তৈরি করতো। অবশ্য প্রত্যেক সম্প্রদায়ের তৈরি বস্ত্র সামগ্রীর আলাদা নকশা, রঙ ও নাম রয়েছে। কোমর তাঁতে কাপড় বোনার ঐহিত্য শত শত বছরের পুরনো। সেই সময় থেকেই পাহাড়ি নারীরা নিজেদের পরনের কাপড় নিজেরাই বুনতেন। কোমর তাঁতেই বোনা হতো এসব কাপড়। একটা সময় কোমর তাঁতে কাপড় বোনার সক্ষমতাই ছিল বিয়ের কনের মূল যোগ্যতা। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বেশিভাগই জুম চাষে নির্ভরশীল। নারীরা ঘরের কাজের পাশাপাশি কৃষিকাজ করেন। অবসরে কোমর তাঁতে কাপড় বোনেন। সেই ঐতিহ্য এখন আর নেই। দুর্গম পল্লী-গ্রামের নারীদের হাত ধরেই এখনো যা একটু টিকে আছে এই শিল্প।

কোমর তাঁতের কারিগররা জানায়, বন উজাড়ের কারণে আগের মত জঙ্গলে সরঞ্জাম তৈরির বিশেষজাতের কাঠ ও বাঁশ পাওয়া যায় না। জুম চাষও কমে গেছে। কার্পাস তুলা বা সুতা রঙ করার সেই গাছ-গাছালিও নেই। এছাড়া সনাতনী পদ্ধতিতে তুলা থেকে সুতা তৈরিও সময় সাপেক্ষ। তাই কোমরতাঁতের প্রযুক্তি সরঞ্জাম, কাঁচামাল সব কিছুই বাজার থেকে কিনতে হয়। আর বাজারে সুতাসহ প্রায় সব ধরনের উপকরণের দামই বেড়েছে। তাই এখন আর কাপড় তৈরি করে পোষায় না।

প্রতিভা ত্রিপুরা নামে একজন সৌখিন কোমরতাঁতি বলেন, বর্তমান বাজারে পাহাড়ি নারীর হাতে তৈরি একটি শীতের কম্বল বিক্রি করা যায় ৪০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত। এমন একটি কম্বল তৈরিতে উল কিনতে হয় প্রায় সাড়ে ৩০০-৪০০ টাকার। এছাড়া উল কিনে মার দেয়া, টানা দেয়া, শুকানো এবং বুননে যে সময়, শ্রম ও মেধা ব্যয় করতে হয় তাতে পারিশ্রমিক উঠে আসে না।

সিমি চাকমা নামে আরেক গৃহবধূ বলেন, এটি আমাদের চাকমাদের ঐতিহ্য। যুগ যুগ ধরে আমরা কাপড় বুনন করে আসছি কোমর তাঁত দিয়ে। এখন বাজার থেকে সুতা কিনে কাপড় তৈরি করব, সেই সামর্থ্য নেই। সুতার দাম বাড়তি। তাই সরকার আমাদের কম-মূল্যে সুতা দিলে খুবই উপকৃত হবো।

নারী নেত্রী ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য শেফালিকা ত্রিপুরা জানান, এখানকার লোকজন যতই পড়ালেখা শিখছে, ততই ভুলছে নিজের ঐতিহ্যগাঁথা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছু ভুলে যাওয়া ঠিক নয়; তাতে ভবিষ্যৎ ভালো হয় না।

তিনি বলেন, ‘শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি নিজের জন্য, পরিবারের জন্য কোমর তাঁতে কাপড় বুনি। নিজে ব্যবহার করি। প্রতিবেশী, স্বজন ছাড়াও গরীবদেরও দিই। এ শিল্প বাঁচাতে হলে, পাহাড়িদের মধ্যে আগের মত আগ্রহ-উৎসাহ বাড়াতে হলে সবচেয়ে বেশি দরকার পূঁজির যোগান দেওয়া। এ ক্ষেত্রে সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদ ও তা সহজলভ্য করলে অনেকেই এগিয়ে আসবে। এছাড়া বাজারজাত করারও সুযোগ করে দিতে হবে।’

মারমা উন্নয়ন সংসদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য মংপ্রু চৌধুরী বলেন, আধুনিকতার মোহে পাহাড়িদের অনেক ঐতিহ্য , সংস্কৃতির মত কোমর তাঁতও বিলুপ্ত হতে চলেছে। অবশ্য মারমা সংসদসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এসব ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য সচেতনতামূলক কাজ করছে। তিনি বলেন, এসব সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারেরও দায়িত্ব আছে। কোমর তাঁত রক্ষায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিভাগের ভূমিকা আবশ্যক।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিসিক)খাগড়াছড়ির উপ-ব্যবস্থাপক মো. আলী আল রাজী বলেন, বিশেষত, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বহু নারীকে উল-সুতা ও তাঁত সহায়তা দেয়া হতো। বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে উৎপাদিত পণ্য বিসিক কিনে এনে তা ১০ শতাংশ লাভে বিক্রি করার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া বিসিকের আশির দশকে চালু হওয়া সিআরআইডিপি (মূল প্রকল্পটি) মাঝ পথে বন্ধ হওয়ায় প্রশিক্ষণসহ অনেক সরকারি সহায়তাই এখন আর নেই।’

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বিসিকের মাধ্যমে ফ্রেম তাঁত ও গর্ত তাঁতের প্রশিক্ষণ, উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। কিন্তু কোমর তাঁত নিয়ে তাদের কোন কার্যক্রম নেই।’