
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
ইতিহাসে বহু প্রমাণ রহিয়াছে, যেইখানে মেধাবীরা লোভের কারণে আত্মবিনাশের পথে চলিয়াছেন। আমরা এই ক্ষেত্রে গ্রিক পুরাণের একটি কাহিনি স্মরণ করিতে পারি। ইকারাসের কাহিনিতে ইকারাস ও তাহার পিতা ডেডালাস মোম ও পালকের ডানা বানাইয়া আকাশে উড়িয়াছিলেন পিতা তাহাকে সাবধান করিয়াছিলেন, সূর্যের খুব নিকটবর্তী না হইবার ব্যাপারে। কিন্তু উচ্ছ্বাস ও সীমাহীন উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে ইকারাস পিতার পরামর্শ অগ্রাহ্য করিলেন।
সূর্যের তাপে তাহার ডানা গলিয়া পড়িল এবং সে সাগরে পতিত হইয়া মৃত্যুবরণ করিল। ইহা দেখাইয়া দেয়, বুদ্ধির সহিত আত্মনিয়ন্ত্রণ না থাকিলে তাহা ধ্বংসের কারণ হইতে পারে। মানুষের জীবনে মেধার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে মেধার সহিত যদি পরিণামদর্শিতা যুক্ত না থাকে, তাহা হইলে তাহা আত্মবিনাশের কারণ হইতে পারে। প্রকৃত বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানেন, কবে থামিতে হইবে এবং কোন কাজ করিলে তাহার জন্য বিপদ অপেক্ষা করিতেছে। কিন্তু অনেক মেধাবী ব্যক্তি লোভে অন্ধ হইয়া এমন কিছু কর্মে লিপ্ত হন, যাহার ফলস্বরূপ তাহাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। শুধু পুরাণে নহে, বাস্তব জীবনেও এই সত্য প্রতিফলিত হয়। আধুনিক বিশ্বে বহু অর্থনীতিবিদ ও প্রযুক্তিবিদ মেধার গর্বে অন্ধ হইয়া এমন সমস্ত কাজ করিয়াছেন, যাহা তাহাদের পতন ডাকিয়া আনিয়াছে। এনরন কেলেঙ্কারির কথা বলা যায়, যেইখানে অত্যন্ত মেধাবী নির্বাহীরা প্রতারণার আশ্রয় লইয়া কোম্পানিটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলিয়া দিয়াছিলেন।
তাহাদের মেধা ছিল, কিন্তু পরিণামদর্শিতা ছিল না। শেস্পিয়রের ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে আমরা দেখি, কীভাবে লোভ একজন বীর সৈনিককে অপরাধীর পর্যায়ে নামাইয়া আনিয়াছিল। তাহার রাজা হইবার বাসনা, তাহার অপরিণামদর্শী উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাহাকে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত করিয়াছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাহাকে নির্মমভাবে পরাজিত হইতে হয়। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের জীবন হইতেও আমরা শিক্ষা পাই। তিনি বিশ্বের অর্ধেক জয় করিয়াছিলেন, কিন্তু লোভ ও অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে নিজের সেনাদের ক্লান্তি ও সীমাবদ্ধতা বুঝিতে ব্যর্থ হইলেন। ফলস্বরূপ, তিনি স্বদেশে ফিরিবার পূর্বেই অকালমৃত্যুর শিকার হইলেন।
আধুনিক সময়ে মেধাবীরা যখন অপরাধী হইয়া উঠেন, তখন তাহারা ভয়ংকর রূপ ধারণ করেন। কেননা যে কোনো ধরনের অপরাধে যখন মেধার সমন্বয় ঘটে-তখন তা হয় নিপুণ, প্রায় নির্ভুল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বেগ পাইতে হয় সেই অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করিতে। অ্যাকশন থ্রিলার সিনেমাগুলিতে এই সকল কাহিনি আমরা দেখিতে পাই। একবার পশ্চিমা দেশের একজন সিরিয়াল কিলার একের পর এক খুন করিবার পরও পুলিশ তাহাকে টিকিও ছুঁইতে পারিতেছিল না। ঐ সিরিয়াল কিলার শেষ অপরাধ করেন অত্যন্ত হিসাবনিকাশ করিয়া, আর তাহার পরই সে ধরা পড়িল পুলিশের জালে। পুলিশ তাহাকে ধরিবার পর জানিতে চাহিলেন তিনি এত বুদ্ধিমান হইবার পরও এইবার এত আনাড়ি ও বোকার মতো খুন করিলেন কেন? সিরিয়াল কিলার বলিলেন, এই খুনটিই তিনি সবচাইতে বেশি পরিকল্পিতভাবে করিয়াছেন!
সুতরাং যতই পরিকল্পনা করিয়া অপরাধ করা হউক না কেন, কোনো না কোনো ত্রুটি বা আলামত অপরাধীরা রাখিয়া যানই। আর তাহার সূত্র ধরিয়া অপরাধীর নাগাল পাওয়া খুব কঠিন হয় না। এই জন্য পবিত্র কুরআনে ইহা স্পষ্টভাবে বলা হইয়াছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী’ (সুরা আনফাল: ৩০)। অর্থাৎ মানুষ যতই অন্যায় পরিকল্পনা করুক, তাহা বাস্তবায়িত হওয়া নির্ভর করে বৃহত্তর বিধানের উপর। প্রকৃতপক্ষে যাহারা বুদ্ধিমান, তাহারা জানেন-কোনো কিছুই চিরকাল স্থায়ী নয়। অপরাধ বা অন্যায় যত নিখুঁতভাবে করা হউক না কেন, তাহার মধ্যে ফাঁকফোকর থাকেই।
সুতরাং, সাময়িক সময়ের জন্য অন্যায়ের মাধ্যমে কেহ জয়ী হইলেও শেষ বিচারে তাহার পরাজয়ই ঘটে। এই জন্য ‘নো দাইসেলফ’ কথাটি বারংবার বলা হয়। নিজেকে সর্বাগ্রে চিনিতে হয় এবং বুদ্ধিমানরা নিজেদের চিনিয়া থাকেন। কেবল নিজেকে জানিলেই আমরা বুঝিতে পারি-আমাদের দৌড় কত দূর, আমাদের কী করা উচিত এবং কী করা উচিত নহে।