নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেলোয়ারা বেগমকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় হয়তো তাঁর অবচেতন মন টের পেয়েছিল, আদরের নাতির সঙ্গে এটাই হতে পারে শেষ দেখা। তাই বহু কষ্টে চার মাসের ইয়াসিনকে জড়িয়ে চুমু খেয়েছিলেন। কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ইয়াসিনের দিকে। তারপর সেই যে হাসপাতালে গেলেন, আর ফিরলেন না ৩৬ বছর বয়সী দেলোয়ারা। এখন ঘরে স্বামী, চার সন্তান ও একমাত্র নাতি আছে। নেই শুধু তিনি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৩ অক্টোবর রাতে মারা যান পরিবারের মধ্যমণি এই নারী।
রাজধানীর দক্ষিণখানের গাওয়াইর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকে দেলোয়ারার পরিবার। গতকাল শুক্রবার সকালে ওই বাসায় দেখা যায়, একমাত্র মেয়ে খাদিজা রান্নার জন্য কাটাকুটি করছেন। যে শয়নকক্ষে দেলোয়ারা থাকতেন, সেখানেই বিছানায় শুয়ে আছে ইয়াসিন। তাকে দেখভাল করছেন আত্মীয় সানজিদা। পাশে খেলা করছে দেলোয়ারার ছোট ছেলে আব্দুল্লাহ। এর মধ্যেই মায়ের হাসপাতাল যাত্রার আগের স্মৃতিচারণ করেন মেয়ে খাদিজা।
তিনি জানান, মায়ের মৃত্যুর পর অনেকটা জেদি হয়ে উঠেছে ছয় বছরের আব্দুল্লাহ। যখন-তখন নানা জিনিসপত্র দেওয়ার বায়না ধরছে। না দিতে পারলেই বলে উঠছে, ‘আমার মায়রে আইনা দাও।’ আব্দুল্লাহ জেনেছে মা বেঁচে নেই। তবু সে মায়ের ফেরার অপেক্ষায় থাকে। প্রতি রাতে নামাজ পড়ে কাঁদে। দেলোয়ারার মেজো ছেলে আশরাফুল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার গঙ্গানগর গ্রামের এক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ক’দিন আগে ঢাকায় চলে আসে মা-বাবার সঙ্গে। এর পর আর স্কুলে ভর্তি হয়নি। আশরাফুল বলে, ‘মাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। মা কেন আমাদের ছাইড়া চইলা গেল?’
২০ বছর বয়সী খাদিজা বলেন, ‘দেড় বছর আগে আমার বিয়ে হয়। স্বামী বিদেশে থাকে। তাই মা-বাবার কাছে চলে আসি। চার মাস আগে আমার ইয়াসিনের জন্ম হয়। তাকে গোসল করানো থেকে শুরু করে সব কাজ মা করত। গত ১৫ অক্টোবর তাঁর জ্বর আসে। পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ানোর পর জ্বর সাময়িক ভালো হলেও আবারও ফিরে আসে। পরে আর রাহা হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে পারি ডেঙ্গু হয়েছে। তার পরও এলাকার ফার্মেসির ওপরই ভরসা করেছিল সবাই। ২০ অক্টোবর মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা জানান, মা স্ট্রোক করেছেন। তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। অবশেষে ২৩ অক্টোবর রাতে মা মারা যান। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শক সিনড্রোমে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
দেলোয়ারার স্বামী সাহাদ মিয়া পেশায় গাড়িচালক। কাওলায় তাঁর নিজস্ব গ্যারেজ আছে। সাহাদ মিয়া বলেন, ‘গাওয়াইর, আশকোনা এলাকায় অনেক ডেঙ্গু রোগী। সাবধান ছিলাম। তার পরও কীভাবে কী হয়ে গেল! একই সময়ে আমার বোনের মেয়েও ডেঙ্গু আক্রান্ত ছিল। আমার মেয়েটারও জ্বর হয়। আমরা আসলে ডেঙ্গু নিয়ে অতটা সচেতন না। ডেঙ্গুতে রক্তচাপ কমে গিয়ে কেউ মারা যেতে পারে, তা জানতাম না।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাওলা, আশকোনা ও গাওয়াইর নিয়ে ৪৯ নম্বর ওয়ার্ড। সরেজমিন দেখা যায়, স্যুয়ারেজ লাইনের জন্য কাটা বড় বড় গর্ত, খানাখন্দে দীর্ঘদিন ধরে বেহালদশা সব এলাকার। স্থানীয়রা জানান, অল্প বৃষ্টিতেই অলিগলিতে কোমরসমান পানি জমে যায়। চলাচলের ভোগান্তির পাশাপাশি মশাও এসব এলাকার আরেকটি প্রধান সমস্যা। গত বছর ডিএনসিসির এক জরিপে আশকোনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানা যায়। এ বছরও সে চিত্র পাল্টায়নি।