আলোর মুখ দেখছে তিতাস: আবারও এমডি পদে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ পেলেন হারুনুর রশীদ

প্রকাশিত: ৭:৩৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৬, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত পেট্রোবাংলার একটি প্রতিষ্ঠান ‘তিতাস গ্যাস ট্রান্অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি’ রাষ্ট্রীয় ও জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সংস্থাটির ব্যাপক অনিয়ম-দূর্নীতিরোধ, জ্বালানি খাতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো, গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধিসহ সংস্থাটিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করায় ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্কে আবারও তৃতীয় মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সংস্থাটির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্র কঠোর নেতৃত্বে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে জ্বালানি খাতের এ সংস্থাটি। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তিতাসের এমডি। তার নেতৃত্বে তিতাস গ্যাস তার সেবার মাধ্যমে জনগণের আস্থাভাজন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। জ্বালানি খাতে কাঙ্খিত সেবা প্রদানের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২ অর্জন করেছে। এই অর্জনের বড় অংশীদার তিতাস গ্যাস। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালকের তত্ত্বাবধানে এবং কঠোর দিক-নির্দেশনায় বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) বাস্তবায়নে ২০২১-২২ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা ধরে রাখতে নিরলস কাজ করছেন সংস্থাটির এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। জ্বালানি খাতের এ সংস্থাটিকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যেই ৯ জনকে বরখাস্তসহ ৭৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি প্রদান ও ১২৮৩ জনকে বদলি করা হয়েছে। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে আরও অনেককে শোকজ নোটিশ প্রদানসহ কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ, জরিমানা করা ও বকেয়া আদায়ের লক্ষ্যে সরকারের রাজস্ব বাড়াতে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৩ কোটি ৯১৯ টাকা আদায় করেছে সংস্থাটি। আজ বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত পেট্রোবাংলার একটি প্রতিষ্ঠান ‘তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি’। জ্বালানি খাতের রাষ্ট্রীয় ও জনসেবামূলক এ প্রতিষ্ঠানটি যুগ যুগ ধরে ব্যাপক অনিয়ন-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কঠোর নির্দেশনার পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেননি। গ্রাহকদের কাছে পর্যাপ্ত গ্যাস বিক্রয় ও বিতরণ করেও লাভের মুখ দেখেনি। বরং এ সংস্থাটিতে কর্তব্যরত কতিপয় স্বার্থান্বেসী মহলের অপতৎপরতায় সিস্টেম লসসহ ব্যাপক অনিয়ন-দুর্নীতি আর বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে নানামুখী সংকট সৃষ্টি করে। যার ফলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস লোকসানের ঘানি টেনে একটি অ-লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ ধারণ করে তিতাস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতিতে উত্তেরণের উপায় খুঁজে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। খোদ সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও তিতাসকে ঢেলে সাজাতে কঠোর দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সুপারিশ ও পরামর্শে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তিতাসকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনতে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্কে প্রথম দফায় একবছর মেয়াদী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগ প্রাপ্তির পর ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর এমডি পদে যোগদান করেন তিনি। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সংস্থাটিতে কর্মরত সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে পরিচিতি ও মতবিনিময় সভা করেন প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। সেই থেকেই তিনি বিভিন্ন জোন, আঞ্চলিক অফিস ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কঠোর দিক-নির্দেশনা দেন। তারই ধারাবাহিকতায় সংস্থাটির ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এমডি’র দূরদর্শীতা ও সততার মাধ্যমে কঠোর দিক-নির্দেশনার কারণে ধীরে ধীরে আলোর মুখ দেখতে শুরু করে রাষ্ট্রীয় ও জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ‘তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি’। তার চুক্তিভিত্তিক মেয়াদকাল শেষ হয় ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। এরপর তার কৃতকর্মে সন্তুষ্টি হয়ে সরকার তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে এমডি পদে বহাল রেখে ২০২২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একবছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন। পরবর্তীতে তিনি তার কর্মদক্ষতায় সংস্থাটির সিস্টেম লস কমিয়ে গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধিসহ সরকারের জ্বালানি খাতে রাজস্ব আয় বাড়াতে পুরোদমে তৎপরতা শুরু করেন। এরপর সরকার যখন তাকে তৃতীয় মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, ঠিক তখনই তার নিয়োগ ঠেকাতে স্বার্থান্বেসী একটি মহল অপতৎপরতা শুরু করে। ওই মহলটি মিথ্যা অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দাখিল করেন। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় তিতাসের এমডি পদে আবারও তৃতীয় মেয়াদে ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একবছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়িয়ে দিয়েছেন।


তিতাসের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, সংস্থাটিতে ভালো কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পরপর তৃতীয় বারের মতো প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্কে এমডি পদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এটা একটা বিশাল অর্জন। তার এই মেয়াদ বৃদ্ধি তিতাস কোম্পানিতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তারা আরও বলেন, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ গত ২ বছরে সংস্থাটির ভেতরে বিভিন্ন অনিয়ম, অবৈধ কার্যক্রমে জড়িত থাকা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে পদস্থ ৯ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্তসহ মোট ৭৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি প্রদান এবং ১ হাজার ২৮৩ জনকে বদলি করেছেন। এছাড়া এমডি’র তত্ত্বাবধানে পরিচালিত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ সংক্রান্তে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের (২০২৩) সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অবৈধ গ্যাস ব্যবহার ও বকেয়ার কারণে আবাসিকে ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮৬টি, শিল্পে ৫১৫টি, বাণিজ্যিক ৫২৯টি, ক্যাপটিভ ১৭৯টি ও ৫৪টি সিএনজি গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। একইসঙ্গে ৭৪৪.৪১ কি.মি. অবৈধ পাইপলাইন অপসারণ করা হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মোট ৪৭০.৯০ কোটি টাকা জরিমানা আদায় করে রাষ্ট্রীয় খাতে জমা দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে গ্রাহকদের কাছে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বকেয়ার পরিমান ছিল ৮,৮৭৯.৩৬ কোটি টাকা। মাসিক গড় বিল ৩,০৯৩.৭৮ কোটি টাকা। যা বকেয়ার সমতুল্য মাস ২.৮৭। কর্মকর্তারা জানান, তিতাসের এমডি প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্র নেতৃত্বে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছ থেকে নানান কৌশলে ৪৩,৯১৯.৯১ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে।
তিতাস কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের লোড বিবেচনায় দৈনিক কম-বেশি চাহিদা ছিল ২,০১০ এমএমসিএফডি। কিন্তু পেট্রোবাংলা কর্তৃক টিডিটিজিসিএল সিস্টেম দৈনিক কম-বেশি সরবরাহ করতো ১৬০০ এমএমসিএফডি। যা ঘাটতি ছিলো ৪১০ এমএমসিএফডি।
সিস্টেম লস সংক্রান্তে সংস্থাটি জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭৪৬৪ গ্যাস ক্রয় (এমএমসিএম) করা হয়। এতে বিক্রয় করা হয়- ১৫১০৮ (এমএমসিএম)। ওই সালে মোট সিস্টেম লস ছিল ২৩৫৬। যা গড় হার ছিল-১৩.৪৯%। ২০২০-২১ অর্থবছরে গ্যাস ক্রয় ছিল ১৮১২৬ (এমএমসিএম), যা বিক্রয় হয় ১৫৮৫৯ (এমএমসিএম)। এতে সিস্টেম লস ছিল ২২৬৭। যা গড় হার ছিল-১২.৫১%। ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্যাস ক্রয় ১৭৫৩১ (এমএমসিএম), যা বিক্রয় হয় ১৫৬৫৮ (এমএমসিএম)। এতে সিস্টেম লস ছিল ১৮৭৪। যা গড় হার ছিল-১০.৬৯%। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্যাস ক্রয় ১৫২৬৫ (এমএমসিএম), যা বিক্রয় হয় ১৪৪৫৯ (এমএমসিএম)। এতে সিস্টেম লস ছিল ৮০৬। যা গড় হার ছিল-৫.৩%। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত গ্যাস ক্রয় ২৭৫৮ (এমএমসিএম), যা বিক্রয় হয় ২৬০৭ (এমএমসিএম)। এতে সিস্টেম লস ছিল ১৫১। যা গড় হার ছিল-৫.৪%।


সিস্টেম লসের কারণ হিসেবে তিতাস জানায়, অবৈধ সংযোগে গ্যাস ব্যবহার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্থকরণ, প্রতিনিয়ত এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত না করে গ্যাস পার্জিং করায়, গ্যাস ইনটেক পয়েন্ট এবং গ্রাহক পর্যায়ে মিটারিং সিস্টেমের ভিন্নতায় পরিমাপজনিত ত্রুটিজনিত কারণে এবং মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের বাড়িতে পাইপলাইনে ক্ষয় ও ত্রুটির কারণে গ্যাসের সিস্টেম লস হচ্ছে। সূত্র জানায়, সিস্টেম লস ঠেকাতে বর্তমান এমডির উদ্যোগে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সরবরাহকৃত পুরোনো ক্ষতিগ্রস্থ গ্যাস লাইন অপসারণ করে নতুন পাইপলাইন বসানো হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাসের অপচয়রোধে প্রতিটি গ্রাহককে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যা আগামী বছরের জুন মাসে এ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। তিতাস গ্যাসের সিস্টেম লস কমিয়ে আনতে এবং এটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তায় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা চলমান রয়েছে।


এদিকে গত ৩ অক্টোবর (২০২৩) সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (অর্থ বিভাগ) অর্পনা ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) নেতৃত্বে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও বকেয়া আদায়ে ৩১,২৫৭টি স্পটে ৩৬৭টি মোবাইল কোর্ট ও সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন জোন ও আঞ্চলিক অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ২৯৪৭৩টি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ঢাকা উত্তরের ৮৭২৭টি স্পটে ৮৮টি মোবাইল কোর্ট ও ৮৩৮৫টি বিশেষ অভিযান, ঢাকা দক্ষিণের ৯৭১৬টি স্পটে ৭০টি মোবাইল কোর্ট ও ৯৪৩৫টি বিশেষ অভিযান, আবিডি-গাজীপুরের ৪৯০২টি স্পটে ৭৮টি মোবাইল কোর্ট ও ৪২৯৭টি বিশেষ অভিযান, আবিডি-নারায়ণগঞ্জের ৪৫৬৪টি স্পটে ১২৯টি মোবাইল কোর্ট ও ৪০৬০টি বিশেষ অভিযান এবং আবিডি-ময়মনসিংহের ৩৩৪৮টি স্পটে ২টি মোবাইল কোর্ট ও ৩২৯৬টি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে ঢাকা উত্তরে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের দায়ে ৯৯,০০৭টি ও বকেয়ার কারণে ২৯২৬১টি গ্রাহকের, ঢাকা দক্ষিণে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের দায়ে ১৩৮৮৫টি ও বকেয়ার কারণে ২৩৮৬৬টি গ্রাহকের, আবিডি-গাজীপুরে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ১০৮৯৫১টি ও বকেয়ার কারণে ২৩৯১৪টি গ্রাহকের, আবিডি-নারায়ণগঞ্জে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ৩৫৯৩৪৩টি ও বকেয়ার কারণে ৬৬১৪টি গ্রাহকের এবং আবিডি-ময়মনসিংহে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ৪৫২টি ও বকেয়ার কারণে ৪১৯৩টি গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবমিলিয়ে মোট ৭৪৪.৪১ কি.মি গ্যাস পাইপলাইন উচ্ছেদ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এসব অভিযানে অন্যান্য গ্রাহক শ্রেণির মধ্যে রয়েছে শিল্প-কারখানায় অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ২৫৯টি ও বকেয়ার কারণে ২৫৬টি, মোট ৫১৫টি। বাণিজ্যে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ৩৬৮টি ও বকেয়ার কারণে ১৬১টি, মোট ৫২৯টি। ক্যাপটিভে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ৫৬টি ও বকেয়ার কারণে ১২৩টি, মোট ১৭৯টি এবং সিএনজি খাতে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে ১০টি ও বকেয়ার কারণে ৪৪টি, মোট ৫৪টি গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ ও জরিমানা করা হয়। এসব গ্রাহকশ্রেণির মধ্যে সবমিলিয়ে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারে সর্বমোট ৬৯৩টি ও বকেয়ার কারণে ৫৮৪টিসহ সর্বমোট ১২৭৭টি গ্রাহকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯-২০ সালে সিস্টেম লসের শতকরা হার ছিল ২% সহ ১৩.৪৯% ও ২% বাদে ১১.৪৯%, ২০২০-২১ সালে ২% সহ ১২.৫১% ও ২% বাদে ১০.৫১%, ২০২১-২২ সালে ২%সহ ১০.৬৯% ও ২% বাদে ৮.৬৯% এবং ২০২২-২৩ সালে ২% সহ ৭.৯০% ও ২% বাদে ৫.৯০%।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বকেয়ার পরিমান ছিল ৫৪০৬.৫১, যার গড়বিল ১৫১০.৮৪, বকেয়ার মাস ৩.৫৮। যা চলতি বিল ১৫৪৩.৫৩ কোটি টাকা বাদে। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বকেয়ার পরিমান ছিল ৪৭৮৯.৯৮, যার গড় বিল ১৫৫৬.১৫, বকেয়ার মাস ৩.০৮। যা চলতি বিল ১৭১৩.০৮ কোটি টাকা বাদে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বকেয়ার পরিমান ছিল৭২১৬.৩৬, যার গড় বিল ২৮৯৯.৬৭, বকেয়ার মাস ২.৪৯। যা চলতি বিল ৩২৪৭.৫২ কোটি টাকা বাদে।
সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক অর্পনা ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে সংস্থাটির ৯ জন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত, ১৪ জনকে সাময়িক বরখাস্ত, ১ জনের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বাজেয়াপ্ত, ১ জনকে নিম্নপদে অবনমত, ৮ জনকে তিরস্কার, ৪৪ জনকে সতর্কীকরণ, ৯ জনকে উপদেশপত্র প্রদান, ২ জনকে পরামর্শপত্র প্রদান, ৮৮ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান ও ১০৫০ জনকে বিভিন্ন স্থানে বদলি করা হয়েছে।


এছাড়াও সংস্থাটিতে ঘাপটি মেরে থাকা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত আরও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের কার্যক্রম ও গতিবিধির ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিতাসের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা।


তারা জানান, সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি। বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করেই কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছেমত তিতাস গ্যাস বিক্রয়-বিতরণ, বিপণন ও গ্যাস সরবরাহ থেকে শুরু করে সংযোগ পর্যন্ত নানা অপকর্ম, ঘুষ বাণিজ্য ও লুটপাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। এতেই সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের দুষ্টচক্রের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন নীতিনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা। তারা আরও বলেন, অবৈধ সংযোগদানে জড়িত থাকা এবং মাঠপর্যায়ের গ্রাহকদের সতর্ক না করে অর্থের বিনিময়ে বিচ্ছিন্ন সংযোগ চালু করে অফিসে ফিরে আসা কর্মকর্তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেন নীতির প্রতি আপোষহীন তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। একই সঙ্গে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নানান অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে এপর্যন্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেন। এতে ওই দুষ্টচক্রটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। চক্রের সদস্যরা এরপরই তার বিরুদ্ধে অপতৎপরতা শুরু করেন। কিন্তু নীতির প্রতি অটল থাকায় কোনো চক্রান্তই তিতাসের এমডিকে দমাতে পারেনি।


তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান এমডি দায়িত্ব গ্রহণের পর এ পর্যন্ত কোম্পানিতে কর্মরত দুই শ্রেণির (১.১ ও ১.২) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাতিল ও কালো তালিকাভুক্ত করেছেন। বাতিলকৃত কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ঠিকাদারি সংকেত নং-১.১/০৭৫ মেসার্স আমির এন্টারপ্রাইজ (০১/০৯/২০২১), ঠিকাদারি সংকেত নং-১.৩/০৪৬ মেসার্স প্রিন্সকো (১৭/১০/২০২৩), ঠিকাদারি সংকেত নং- ১.১/১৯৯ মেসার্স আরাফাত কনস্ট্রাকশন (২৭/০৮/২০২৩), ঠিকাদারি সংকেত নং- ১.১/৩৪৪ মেসার্স রওশন আরা এন্টারপ্রাইজ (২৭/০৮/২০২৩), ঠিকাদারি সংকেত নং-১.১/০৭৮ মেসার্স সাদাফ গ্যাস এন্টারপ্রাইজ (২৭/১২/২০২১), ঠিকাদারি সংকেত নং- ১.১/২৫৫ মেসার্স শরীফ এন্টারপ্রাইজ (২৫/০৪/২০২২), ঠিকাদারি সংকেত নং- ১.১/৩৮৭ মেসার্স জামালপুর গ্যাস (২৫/০৪/২০২২) ও ঠিকাদারি সংকেত নং-১.১ ও ১.২/০০৩ মেসার্স বিক্রমপুর গ্যাস কনস্ট্রাকশন কোং (২৫/০৪/২০২২)। সবমিলিয়ে মোট ৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাতিল ও কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এতে এমডি’র উপর তারাও ক্ষুব্ধ হয়ে নানা ধরণের অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছেন। এসব দুষ্টচক্রের কবল থেকে গুজব এড়াতে সংস্থাটিতে কর্মরত সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে তৃতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া তিতাসের এমডি প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ নিউজ পোস্টকে বলেন, ‘আমার কর্মময় জীবনে আমি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তাই তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি আগের তুলনায় অন্ধকার থেকে আলোর মুখে ফিরে আসছে। গ্রাহক সেবার মানবৃদ্ধিসহ সরকারের রাজস্ব বাড়ানো হচ্ছে।


তিনি আরও বলেন, গ্যাসের বিষয়ে যেখানেই অনিয়ম-দুর্নীতির খবর পেয়েছি, সেখানেই অভিযান চালিয়েছি। কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা আদায় ও সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব ঘটনায় সংস্থাটিতে কর্মরত কারো নাম উঠে আসলে তা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছি। এ কারণেই স্বার্থান্বেসী একটি মহল আমার ওপর বিরাগভাজনে পরিণত হয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়ে সরকারের উপর মহলের নাম ব্যবহার করে আমাকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, গুজব রটাচ্ছে। কিন্তু তাদের সেই ষড়যন্ত্র ভেস্তে গেছে। আমি আমার নীতির প্রতি অটল থেকে সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিতাসের রাজস্ব বাড়াতে এবং গ্রাহক সেবার মানোন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। সিস্টেম লস ও অবৈধ সংযোগ শূণ্যের কোটায় নামিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্।


এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্ন-উত্তরে তিতাস গ্যাস সংক্রান্তে জাতীয় পার্টির সদস্য নাসরিন জাহান রত্নার এক প্রশ্নের লিখিত উত্তরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে চলতি বছরের আগস্টে ১ হাজার ১৩৪টি অভিযান পরিচালনা করে ৪ হাজার ৫৭৫টি সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ এবং ৪১.৪২ কি.মি. পাইপলাইন অপসারণ করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

এছাড়া গ্যাসের অপচয়রোধে আবাসিক গ্রাহকদের পর্যায়ক্রমে প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের প্রকল্প চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।