আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা বিচারের অপেক্ষা শেষ হয়নি দুই দশকেও

প্রকাশিত: ৩:১১ অপরাহ্ণ, মে ৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

গাজীপুরে ২০০৪ সালের এদিনে স্থানীয় এক জনসভায় সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সাংসদ আহসান উল্লাহ মাস্টার। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মধ্যে ২২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন বিচারিক আদালত। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ২০ বছরেও আসামিদের দণ্ড কার্যকরের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা বাদী, আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের করা পৃথক আপিল প্রায় আট বছর ধরে আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্যনুয়ায়ী, আপিল বিভাগে বর্তমানে ৮ জন বিচারপতি রয়েছেন। এরমধ্যে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান হাইকোর্টে আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় রায় দিয়েছিলেন। তাই বিধি অনুসারে তিনি এ মামলাটি শুনানি করতে পারবেন না। এছাড়া আরও একজন বিচারপতি হাইকোর্টে এই মামলার শুনানিতে ছিলেন। এ জন্য ওই দুই বিচারপতিকে বাদ দিয়ে মামলাটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতিকে আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের নিয়ে পৃথক বেঞ্চ গঠন করতে হবে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে কবে আলোচিত এই মামলার বিচারকাজ শেষ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন পরিবার ও স্বজনদের। জানতে চাইলে আহসান উল্লাহ মাস্টারের ছেলে জাহিদ আহসান রাসেল এমপি বলেন, হাইকোর্টের রায়ে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং কয়েকজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে আপিল করেছি। অন্যদিকে দণ্ডিতরাও রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। উভয় আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এই মামলার বিচার শেষ করে রায় বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি আরও বলেন, রায় বাস্তবায়িত হলে আমাদের পরিবার শান্তি পাবে। কারণ যারা সেদিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদের শাস্তি হবে না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমাদের পরিবারের প্রত্যাশা, মামলাটি যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়।

মামলার ভলিউম পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিচারিক (নিম্ন) আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষের করা আপিল এবং আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনে (ডেথ রেফারেন্স) রাষ্ট্রপক্ষের করা পৃথক আবেদনের ওপর ২০১৬ সালে ১৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড বহালের পাশাপাশি ১১ আসামিকে খলাস দেওয়া হয়। পরে আসামিদের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামিরাও। দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি পৃথক ওই আপিল নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চের কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু শুনানির সময় আপিলটি কার্যতালিকা থেকে আপাতত বাদ দেন আপিল বিভাগ। এরপর গত তিন বছর ধরে মামলা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি আপিল নিষ্পত্তির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ঝুলে রয়েছে।

এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী ড. সাইফুদ্দিন মাহমুদ বলেন, আপিল আবেদনগুলো প্রতি মঙ্গল ও বুধবার আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় ২০০ থেকে ৩০০ সিরিয়ালের মধ্যে থাকে। কখনও সামনে এগিয়ে এলেও তা আবার পিছিয়ে যায়। আমরা চাই আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি হোক।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যার্টনি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, আপিল বিভাগের কার্যতালিকা অনুযায়ী মামলাটি নিষ্পত্তি হবে। রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়ে শুনানির জন্য তৎপর রয়েছে।জানতে চাইলে বাদীপক্ষের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মমতাজউদ্দিন ফকির সমকালকে বলেন, আপিল বিভাগে বিচারকের স্বল্পতা ছিল। সম্প্রতি সরকার তিনজন বিচারক নিয়োগ দিয়েছে। আশা করছি চলতি বছরেই মামলাটি নিষ্পত্তি হবে।

২০০৪ সালের ৭ মে সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হন আহসান উল্লাহ মাস্টার। এ ঘটনায় পরদিন তার ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ২০০৪ সালের ১০ জুলাই এ মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দায়ের করে। পরে ঢাকার একটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল প্রধান আসামি বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয় আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। খালাস দেওয়া হয় দুই আসামিকে।

জানা গেছে, ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার পরপরই ওই বছরের বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্টে আপিল করে কারাগারে আটক আসামিরা। এরপর ন্যায়বিচার না পাওয়ার শঙ্কায় ১১ দফা আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের পৃথক আবেদনে হাইকোর্টের একাধিক বেঞ্চ মামলাটি শুনানিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ অপেক্ষার পর ২০১৬ সালের ১৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে নুরুল ইসলাম সরকারসহ ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল, ৭ জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং ১১ আসামিকে খলাস দেওয়া হয়। রায়ে এই হত্যাকাণ্ডকে ‘মাসকিলিং’ হিসেবে উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন ‘আসামিরা হত্যা করেছে একটি আদর্শকে। আজকের সমাজে আহসান উল্লাহ মাস্টারের মত আদর্শবান রাজনৈতিক নেতার বড়ই অভাব।’

মামলার নথি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড বহাল হওয়া আসামিরা হলেন- নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ ও সোহাগ ওরফে সরু। সাজা কমে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত সাত আসামি হলেন– মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া, জাহাঙ্গীর (পলাতক), মশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম। এ ছাড়া আসামি নুরুল আমিনকে বিচারিক আদালতের দেওয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।

অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া ১১ জন হলেন- আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া, রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনির।হাইকোর্টের রায়ের পর খালাস পাওয়া আসামিদের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও আপিল বিভাগে পৃথক আবেদন করেন। এরপর থেকে বাদী, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিদের করা পৃথক আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।