উন্মুক্ত স্থানে টন টন বর্জ্য দুর্গন্ধে টেকা দায়

প্রকাশিত: ১২:৫৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৩, ২০২৪

কুমিল্লা প্রতিনিধি:

কুমিল্লা নগরীর অদূরে জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর এলাকায় রয়েছে সিটি করপোরেশনের (কুসিক) ১০ দশমিক ৩৭ একরের ময়লার ভাগাড়। বিবিরবাজার স্থলবন্দর সড়কের পাশে প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো ভাগাড়টি স্থানীয়দের জন্য ‘নরক যন্ত্রণা’র আরেক নাম। প্রতিদিন কুসিকের ২৭টি ওয়ার্ডের বাসাবাড়ি ও বাজারের প্রায় ২০০ টন বর্জ্য ফেলা হয় উন্মুক্ত এ ভাগাড়ে। রিসাইক্লিং সুবিধা না থাকায় পচেগলে সেই বর্জ্যে ছড়ায় তীব্র দুর্গন্ধ। অবস্থা এতটাই খারাপ, প্রায় এক কিলোমিটার আগে থেকে নাক চেপে চলতে হয়। আশপাশের ২০-২২টি গ্রামের বাসিন্দার সেই সুযোগও নেই। অসহ্য দুর্গন্ধের মধ্যেই বছরের পর বছর পার করছেন তারা।
সরেজমিন এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাগাড়টির ধারণ ক্ষমতা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এর পরও প্রতিদিন টন টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। উন্মুক্ত পরিবেশে ময়লা ফেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে ভাগাড়টি সরাতে আন্দোলন করে এলেও কাজ হয়নি।
তারা আরও জানান, আগুন দিয়ে আবর্জনা পোড়ানোর ধোঁয়া আর বৃষ্টিতে পচা বর্জ্যে দুর্গন্ধ ছড়ায় পাশের ঝাঁকুনিপাড়া, দৌলতপুর, জগন্নাথপুর, বালুতুপা, খামার কৃষ্ণপুর, অরণ্যপুর, বাজগড্ডা, বারপাড়া, তেতুইপাড়া, দাউদের খেরা, মনাগ্রাম, চাঁপাপুর (উত্তর ও দক্ষিণ), পাঁচথুবী ইউনিয়নের সুবর্ণপুর, নগরীর সংরাইশসহ কয়েকটি গ্রামে। এতে সেখানকার মানুষের বসবাস করার উপায় নেই।
ভাগাড়ের উত্তর পাশের বাসিন্দা রাশেদা বেগম জানান, ২১ বছর আগে বিয়ের পর তিনি এ এলাকায় আসেন। তখন ভাগাড় এলাকায় ছোট একটি ঘরে সরকারি হাসপাতালের লাশ কাটা হতো। পাশে ফেলা হতো তৎকালীন কুমিল্লা পৌরসভার আবর্জনা। এখন সেখানে ময়লার পাহাড়। মশা-মাছির উৎপাত এবং উৎকট গন্ধে টেকা দায় হয়ে পড়েছে।
ভাগাড়ের ৩০০ গজ উত্তরে বিসমিল্লাহ হাউসের বাসিন্দা জিয়া উদ্দিন বলেন, উন্মুক্তভাবে ময়লা ফেলে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করা হচ্ছে। বৃষ্টির সময় কিংবা বাতাস হলে ঘরের মধ্যে থাকাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। মদিনা ফার্নিচারের মালিক মো. হাসান বলেন, অন্য কোনো স্থানে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় কষ্ট করেই এখানে আছেন।
পাশের জাকুনীপাড়ার ফুল মিয়া বলেন, এলাকাবাসী কয়েকবার বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করলেও কেউ নজর দেয়নি। একই এলাকার সুজন মিয়া বলেন, গত সিটি নির্বাচনের আগে তখনকার মেয়র দুর্গন্ধ ছড়ানো ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলেও কোনো পদক্ষেপ নেননি।
জগন্নাথপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ বলেন, বর্জ্যের দুর্গন্ধ এবং আবর্জনায় দেওয়া আগুনের ধোঁয়ায় আশপাশের তিন-চার কিলোমিটার এলাকার প্রায় ২০-২২টি গ্রামের পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এখানে আধুনিক পদ্ধতিতে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করার দাবি জানাচ্ছি। এটি হলে তিন দশকের যন্ত্রণা থেকে লোকজন রেহাই পাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ময়লার ভাগাড় থেকে উৎপন্ন মিথেনসহ বিষাক্ত গ্যাসে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে বর্জ্য থেকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। কুসিক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করছি।
আবর্জনা থেকে হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে এই ভাগাড়ের আবর্জনা পরিশোধনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল কুসিক কর্তৃপক্ষ। তবে প্রকল্পটি এখনও সমীক্ষা পর্যায়ে আছে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে এমন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন। গত ৯ জুন ওই এলাকা পরিদর্শন শেষে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা জানিয়েছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এবং কুসিক মেয়র ডা. তাহসীন বাহার সূচনা। চীনা কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ টিম এলাকাটি পরিদর্শন করে। তবে সেই প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতির খবর নেই কুসিকের কাছে।
কুসিকের প্রধান প্রকৌশলী গৌতম প্রসাদ চৌধুরী (জিপি চৌধুরী) সমকালকে জানান, আবর্জনা থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে চীন কারিগরি সহায়তার কথা জানিয়েছে। সমীক্ষা চলমান আছে। ২৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এলাকাবাসীর দুর্ভোগ আর থাকবে না। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ভাগাড়ের ভেতর সড়ক নির্মাণ, ময়লা সংরক্ষণ, ভারী যানবাহন ক্রয় এবং আরও ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরও একটি প্রকল্প নেবে।
কুসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম সমকালকে বলেন, বলা যায় এটি একটি মেগা প্রকল্প। এতে সরকারের অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় নথি আগেই মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আছে। তবে এ প্রকল্প নিয়ে আপাতত কোনো সুখবর নেই।