নদী রক্ষার ক্রাশ প্রোগ্রামে সারাদেশের ৪৯ হাজার ১৬২ জন অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হবে। এক বছরের মধ্যে শেষ হবে উচ্ছেদ অভিযান। এর বাইরেও কেউ নদী দখল করে থাকলে, তাদের নাম আসবে দ্বিতীয় তালিকায়। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় তালিকা প্রস্তুতের তথ্যও মাঠ পর্যায় থেকে সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। পাশাপাশি নদী রক্ষা আইন সংস্কার ও ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ নদী কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮ প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সম্মেলনে কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার, সদস্য মো. আলাউদ্দিনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের আগস্টে নদী দখলদারদের প্রথম তালিকা প্রকাশ করে কমিশন। এই তালিকায় দেখা যায়, শুধু ঢাকায় দখলদারের সংখ্যা ৯৫৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। নোয়াখালী জেলায় সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫৮৩ জন দখলদারের নাম রয়েছে। সবচেয়ে কম দখলদার লালমনিরহাটে। দখলদারের সংখ্যা ১৪ জন।
সংবাদ সম্মেলনে কমিশন চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘আমরা এক বছরের ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। এরমধ্যে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে। প্রভাবশালীদের দখল উচ্ছেদের বিষয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কোনও প্রতিবন্ধকতার মুখে না পড়লেও স্থানীয়ভাবে আইন প্রয়োগকারীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে এসব প্রভাবশালী।’ তিনি বলেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি মাঠপর্যায়ে যাদের নদী রক্ষায় কাজ করার কথা তারা সেটি করছেন না। বিশেষ করে জেলা প্রশাসন নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদে খুব একটা আগ্রহী নয়। নদী কমিশনের আইনের সংস্কার করা হচ্ছে। এই আইনে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে তাদের জবাবদিহিতার বিধান যোগ করা হচ্ছে।’
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হলে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দরকার, তা দেওয়া হয় না। এজন্য সরকারের কাছে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের সুপারিশ করেছে নদী কমিশন।’ তিনি বলেন, ‘সরকার এই জমি উদ্ধার করে উন্নয়ন কাজ করতে পারে। বনায়নও করা যেতে পারে।’
সংবাদ সম্মেলনে নদীগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। তাতে বলা হয়, আগে শোনা যেতো বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ৮০০। কিন্তু এখন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৪০৫টি। এরমধ্যে আবার বেশিরভাগেরই অবস্থা মরণাপন্ন। দূষণ, দখল, ভাঙন ও চর সবমিলিয়ে খুবই খারাপ অব্স্থায় আছে নদীগুলো। ঢাকার একপাশে বুড়িগঙ্গা, অন্যপাশে তুরাগের দূষণ সবচেয়ে বেশি। শিল্প-কারখানাগুলোর দূষণ আর দখলে নদীর অবস্থা খুবই করুণ। একদিকে উচ্ছেদ হচ্ছে অন্যদিকে আবার দখল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ঢাকার পাশের বালু নদীর অবস্থাও একই। এছাড়া ঢাকার খালগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। শিল্প দূষণের শিকারের তালিকায় আছে বংশাই নদী, চিলাই নদী, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, ময়নাকাটা নদী, পাচুরিয়া খাল, গোমতি নদী, সোমেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘড়া খাল, গিরিজা খাল, হালদা নদী, এরসঙ্গে যুক্ত ১৮টি খাল, কর্ণফুলী নদী, পাশের চাকতাই খাল, সাঙ্গু নদী, ধানসিঁড়ি নদী, গাবখান চ্যানেল। অন্যদিকে দখলের কারণে মেঘনা নদী অর্ধেক হয়ে গেছে। পিয়াইন নদী থেকে অবাধে পাথর উত্তোলন, টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া পঞ্চগড় ও নীলফামারীর নদীগুলোও এখন দূষণ, দখল ও অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকির মধ্যে আছে।
সম্মেলনে জানানো হয়, এত নদী, এত কাজের জন্য কমিশনের লোকবল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া নদী রক্ষায় মোবাইল কোর্ট ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কমিশন আইনের সংস্কারে এসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। আইনটি পাস হলে নদী রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে বলেও এই সময় জানানো হয়।
দেশের প্রভাবশালী পাঁচটি শিল্প গ্রুপের বিরুদ্ধে নদী দখলের অভিযোগ এনে কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা মন্ত্রী, সচিবদের সঙ্গে আলাপ করেছি। আমরা তাদের জানিয়েছি, কোথায় কোন প্রভাবশালী দখল করে রেখেছেন। এসব জায়গায় উচ্ছেদ করতে গেলে সমস্যা হতে পারে আশঙ্কা করেই বলেছি, আপনারাও আমাদের সঙ্গে উচ্ছেদ অভিযানে চলুন।’
সংবাদ সম্মেলনে কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমরা সরেজমিনে দেখেছি শীতলক্ষ্যা এবং মেঘনাতে প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে নদীর ৩০০ থেকে ৫০০ মিটার দখল করে কারখানা স্থাপন করেছে এসব প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপ। সীমাহীনভাবে তারা নদী দখল করেছে।’ সাত কিলোমিটারের কম হবে না বলেও তিনি মনে করেন।