নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ তাহমিদ আয়হাম হত্যার সাড়ে আট মাসের বেশি সময় পার হয়েছে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে অবহেলার কারণে শিশুটির মৃত্যুর বিষয়টি উঠে এসেছে। পুলিশের তদন্তেও চিকিৎসকের গাফিলতি পরিষ্কার। তবে এখনও বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দিহান পরিবার। স্বজনদের অভিযোগ, অভিযুক্তদের হুমকি-ধমকিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। আয়হামের সার্জারিতে অংশ নেওয়া তিন চিকিৎসকের অবহেলার প্রমাণ পাওয়ায় তাদের অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
গত ২০ ফেব্রুয়ারি সুন্নাতে খতনা করাতে গিয়ে রাজধানীর মালিবাগ জে এস হাসপাতালে মৃত্যু হয় আয়হামের। ঘটনার পরদিন ঢাকার হাতিরঝিল থানায় তিন চিকিৎসকের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন নিহতের বাবা ফখরুল আলম। আসামি করা হয় হাসপাতালটির পরিচালক ডা. এস এম মুক্তাদির, অ্যানেস্থেসিয়া চিকিৎসক ডা. মাহাবুব মোরশেদ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক ইশতিয়াক আজাদকে। তাদের নামে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। ঘটনার পর মুক্তাদির ও মাহাবুবকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বর্তমানে জামিনে আছেন তারা। আর ঘটনার পর হাইকোর্ট থেকে জামিন নেন ইশতিয়াক।
ফখরুল আলমের অভিযোগ, ‘ছেলের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন আমরা পাওয়ার আগেই জামিন পেয়েছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক ইশতিয়াক আজাদ। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে আমার খিলগাঁওয়ের বাসায় আসেন ইশতিয়াক। তিনি পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দেন। তাঁর স্ত্রী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চাকরি করেন জানিয়ে মামলায় তাঁর কিছুই হবে না বলেও দম্ভ প্রকাশ করেন। এভাবে একজন আসামি বাসায় এসে হুমকি দিতে পারে– ভাবতেও পারিনি।’
অভিভাবককে না জানিয়ে ‘ফুল অ্যানেস্থেসিয়া’ দেওয়া হয় আয়হামকে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে ভয়াবহ অবহেলার কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, দুটি চেতনানাশক ইনজেকশন দেওয়ার কারণে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে আয়হাম। তার রক্তে দুই ধরনের চেতনানাশক পাওয়া গেছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশ বলছে, ‘চিকিৎসক এস এম মুক্তাদির ওই হাসপাতালের পরিচালক হওয়ার পর ১৫-১৬ জনের একটি চক্র গড়ে তোলেন। এ চক্রের সদস্যরা বিভিন্নভাবে রোগীদের ফুঁসলিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসতেন। পরে তাদের অবৈধভাবে অপারেশন করানো হতো। প্রচারের উদ্দেশ্যে ২০২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে ফ্রিতে ১৫-১৬ শিশুকে সুন্নাতে খতনা করেন। এ সময় সার্জারির দায়িত্ব পালন করেন চিকিৎসক ইশতিয়াক আজাদ। এর পর থেকে ওই অবৈধ হাসপাতালে নিয়মিত সুন্নাতে খতনা করাতেন তারা। তবে ঘটনার দিন রোগীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ইশতিয়াক পালিয়ে যান।’
আয়হামের মা খায়রুন নাহার বলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যা করল। এখন আবার আমাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। ময়নাতদন্ত ও পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনেও হত্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। তার পরও অদৃশ্য কারণে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এখন ছেলে হত্যার বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।’
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, আয়হামের কক্ষটি আগের মতোই আছে। পড়ার টেবিলে সাজানো বইখাতা। স্কুল ব্যাগটাও আছে আগের জায়গায়। আয়হামের ব্যবহৃত জিনিসপত্রে লেগে থাকা তার স্পর্শ নষ্ট হবে– এই ভয়ে কক্ষে কাউকে থাকতে দেন না খায়রুন নাহার। তিনি বলেন, ‘আয়হামের জামাকাপড় ও একটি পানির কাপ সর্বশেষ স্মৃতি। আমার যখন খুব বেশি মন খারাপ হয়, তখন ওর জামাকাপড়গুলো ধরে থাকি। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না আয়হাম নেই। এখনও মনে হয় আয়হাম স্কুলে আছে, বাসায় আসবে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ বাসায় এলে বলে– আয়হামের টেবিলটা ময়লা হয়ে আছে। বইপত্রে ধুলাবালি জমে গেছে, এগুলো মুছে রাখো। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওর টেবিল মুছতে পারিনি। মুছতে এলে মনে হয় যদি আয়হামের স্পর্শগুলো মুছে যায়! প্রতিটি জিনিসেই ওর স্পর্শ লেগে আছে। ওই রুমে আয়হামের নানি থাকতেন। ওর মৃত্যুর পর রুমটিতে গেলে শুধুই কান্নাকাটি করেন।’
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিয়া বিভাগের প্রধান ডা. এস এম আব্দুল আলিম বলেন, ‘সব ধরনের অ্যানেস্থেসিয়া নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ রয়েছে। ডোজ অতিক্রম করলে যে কোনো বয়সের ব্যক্তিরই হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। আবার ডোজ কম হলেও রোগীর অক্সিজেনের অভাব হবে; কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে রোগী মারা যেতে পারে। রোগীর বয়স ও শারীরিক অবস্থা বুঝেই ডোজ দিতে হবে।’