এগারো বছরেও শুরু হয়নি সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিম হত্যা মামলার বিচার

প্রকাশিত: ১:১২ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৪

# ১৩ আসামি জামিনে ও ১২জন পলাতক
# ১৪ ফেব্রুয়ারি চার্জ গঠনের দিন ধার্য
# ন্যায়-বিচারের প্রত্যাশায় পরিবার

সাইফুল ইসলাম:
রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার নিজ বাসায় দিনে-দুপুরে খুন হন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম খান। নৃশংস এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্ত শেষে বিজ্ঞ আদালতে চার্জশীট দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা সিআইডি। চার্জশীট দাখিলের পরও পেরিয়ে গেছে আরও ৬টি বছর। সবমিলিয়ে প্রায় ১১ বছরেও শুরু হয়নি চাঞ্চল্যকর এই পুলিশ কর্মকর্তা হত্যাকান্ডের বিচার কার্যক্রম। বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক কাদের বিন কাদেরের আদালতে এ হত্যাকান্ডের চার্জ (অভিযোগ) গঠনের জন্য অপেক্ষমান রয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলছেন, আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলার চার্জ বা অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে। সেদিন হয়তো এ মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হতে পারে।

মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালের ২৯ আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডের নিজ বাড়ির তৃতীয় তলায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন ফজলুল করিম খান। এ সময় তার স্ত্রী আফরোজা করিম খান (৪৫) মেয়ের জামাতা ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলীর গুলশানের বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গাড়িচালক নাস্তা খেয়ে দরজা খোলা রেখে বাড়ির নিচে যান। সকাল আনুমানিক ৯টা ২০ মিনিটে দিকে মুখোশধারী ৩ সন্ত্রাসী বাসায় ঢুকে আফরোজা করিম খানকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করেন। অস্ত্রধারীরা তাকে পাশের রুমে নিয়ে স্বর্ণালংকার লুট করে। পরে আফরোজাকে একটি কক্ষে আটকে রাখেন। কাজের ছেলে আজাদকে পাশের আরেকটি বারান্দায় আটকে রাখা হয়। এ সময় অস্ত্রধারী এক সন্ত্রাসী ফজলুল করিমের কক্ষে ঢুকে কপালে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার পর বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরদিন ৩০ আগস্ট তার মেয়ের জামাতা ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলী বাদী হয়ে রামপুরা থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদল হন চার বার। প্রথমে থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত শুরু করে। রামপুরা থানার তখনকার এসআই মোঃ জামাল হোসেন মামলাটির তদন্ত শুরু করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি)। পরে গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোঃ লোকমান হেকিম, পরিদর্শক মোঃ নুরুন্নবী, পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান ও এসআই এএনএম নুরুজ্জামান পর্যায়ক্রমে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এই তদন্তকালীন সময়ে ডিবি পুলিশ মো. শাহজালাল, মো. হাবেল, কাজী মাসুদ পারভেজ ওরফে চৌদ্দ মাসুদ, মো. আল আমিন ওরফে মোল্লা আমিন, হাসান আবদুল বাকী ওরফে হাসান, ইমাম হোসেন শাওন, অর্পন আহমেদ জাভেদ, মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে জনি, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে রুবেল ও মো. বেল্লালকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে ২৭ জুলাই তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ইন্সপেক্টর শেখ মাহবুবুর রহমান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। কিন্তু বাদী ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলী এ অভিযোগপত্রের ওপর নারাজি দেন। পরে আদালত মামলাটির অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে পাঠান। পরে সিআইডির তখনকার সহকারী পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথ প্রায় এক বছর তদন্ত করেন মামলাটি। তদন্ত শেষে তিনিও ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দেন। অভিযোগপত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার রতন কৃষ্ণ নাথ উল্লেখ করেন, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিম অত্যন্ত স্বাধীন চেতা, সমাজসেবক ও সচেতন নাগরিক ছিলেন। মাদকসহ সমাজের যেকোনও অপরাধমূলক কর্মকাÐের বিরুদ্ধ অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন ফজলুল করিম খান। প্রায়ই মাদক প্রতিরোধের চেষ্টা করেন তিনি। হত্যাকাÐের দেড় মাস আগে আসামি শাহরিয়ার আসিফ রাসেলকে কয়েকশ বোতল ফেনসিডিলসহ পুলিশকে ধরিয়ে দেন। এতে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে ফজলুল করিমের দ্ব›েদ্বর সৃষ্টি হয়। এর জের ধরেই হত্যাকাÐের আগের দিন ২০১৩ সালের ২৮ আগস্ট রামপুরার মক্কি মসজিদ গলিতে আসামি এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর ভাড়া বাসায় বসে পুলিশ কর্মকর্তা ফজলুল করিমকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এর পরদিন আসামি এস এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর নেতৃত্বে ওয়াসীম আহমেদ ওরফে রতন, শাহরিয়ার আসিফ ওরফে রাসেল, এনামুল হক পনির, মো. সেলিম ওরফে কলা সেলিম, মো. ইমাম হোসেন শাওন, অর্পন আহমেদ জাভেদ, শফিকুল ইসলাম ওরফে জনি, মো. শাহজালাল, মো. হাবেল, কাজী মাসুদ পারভেজ, মো. আল আমীন, হাসান আবদুল বাকী, আবু বকর ছিদ্দিক ওরফে রুবেল, মো হেমায়েত হোসেন হিমু ওরফে হিমেল খান, মো. রুহুল আমিন, শফিকুল ইসলাম বাদশা, মো. দেলোয়ার হোসেন দেলু, মো. মুন্না, হাজী বাবু, মো. বিপ্লব হোসেন, নাসির শেখ ওরফে সীমান্ত, মামুন ওরফে পাঠা মামুন ও সুজন ওরফে মাস্টার সুজন ঘটনাস্থলে যায়। পরে তিনজন মুখোশপড়া সন্ত্রাসীরা ফজলুল করিমের বাসায় ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, মামলার তদন্ত চলাকালে ১৪ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে ৮ আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাদের জবানবন্দি অনুযায়ী এ হত্যাকাÐের সঙ্গে ২৮ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৭ আগস্ট রাজীব অন্য একটি ঘটনায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যায়। আরেক আসামি বেল্লাল ঘটনার সময় অন্য মামলায় কারাগারে ছিল বলে প্রমাণিত হয়। নাবিদের নাম প্রকাশ পেলেও ভাসমান ও ভবঘুরে হওয়ায় তার সঠিক কোনও নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। ফলে তাদের এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। হত্যাকাÐের ৫ বছর পর অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি।
এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুস সাত্তার দুলাল নিউজ পোস্টকে বলেন, আগামী ১৪ ফেব্রæয়ারি এ মামলার চার্জ বা অভিযোগ গঠনের দিন ধার্য রয়েছে। ওইদিন চার্জ গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী। মামলার বিলম্বের কারণ সম্পর্কে এই আইনজীবী জানান, মামলায় আসামি অনেক। একেক আসামি একেক সময় সময় চেয়ে আবেদন করে। কেউ অন্য মামলায় গ্রেপ্তার থাকে। বিভিন্ন কারণেই বিলম্ব হচ্ছে। তবে বর্তমানে এ মামলার কোনও আসামি কারাগারে নেই। ১৩ আসামি জামিনে ও ১২ জন পলাতক আছে।
এই মামলার বাদী ব্যারিস্টার চৌধুরী মকিম উদ্দিন খান জাহান আলী নিউজ পোস্টকে বলেন, মামলাটি এখন রাষ্ট্র বাদী হয়ে পরিচালনা করছে। আলোচিত এ হত্যাকাÐের দ্রæত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে বলে আমি আশাবাদী।
চার্জ গঠন কিংবা বিচার শুরু না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আসামি মো. হেমায়েত হোসেন হিমু ওরফে হিমেল খানের আইনজীবী মো. লুৎফর রহমান নিউজ পোস্টকে বলেন, একাধিক আসামি বিভিন্ন সময় অব্যাহতিসহ নানা বিষয়ে আদালতে আবেদন করেন। বাদীপক্ষের তৎপরতা কম থাকায় আসামিরা আদালত থেকে সময় নিয়ে চলে গেছেন।