এতদিনের কামাই ভাড়াতেই শেষ, পরিবারের জন্য কিছুই কিনতে পারিনি
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
মোঃ সাইফুল ইসলামঃ
ঈদের খুশি মানেই যেন অন্যরকম আনন্দের ঢেউ। এই ঢেউয়ে সব মানুষের মনই সিক্ত হতে চায়। সবাই চায় ‘ঈদফুলের’ নির্মল সুবাসে পরিবার-পরিজনকে সুবাসিত করতে, জীবনের সব কষ্ট-গ্লানি মুছে ফেলতে। কিন্তু চাইলেই কি হয়? ঈদকে ঘিরে কিছু মানুষের আনন্দ আয়োজন থাকলেও কারো কারো বুক থেকে যেন কষ্টের পাথরগুলো সরতেই চায় না। স্ত্রী-সন্তান আর পরিজনের ঈদের চাহিদা মেটাতে না পেরে নীরবে অশ্রু ঝরান অসংখ্য মানুষ।
সোমবার (৮ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালের এক কোনায় দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে দেখা যায় দুই ব্যক্তিকে। কাছে গিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা জানান, ঈদে বাস ভাড়া ডাবল হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। তাই একটু অপেক্ষা করে খুঁজছেন কিছুটা কমে যাওয়ার উপায়।প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বাস কাউন্টারের পাশে বসে আছেন মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, হালুয়াঘাটের ভাড়া এমনিতে ২৫০ টাকা করে নেয়, আজকে লাগছে ৫০০ টাকা। ৫০০ টাকা রোজে কাজ করি, কোনোদিন কাজ পাই কোনোদিন পাই না। স্ত্রী-সন্তানসহ চলা খুবই কঠিন। এরমধ্যে বাস ভাড়াতেই যদি ৫০০ টাকা চলে যায়, তাহলে আর কিছু করার সুযোগ থাকে কই?
তিনি বলেন, বাড়িতে যাব, বাচ্চারা দৌড়ে আসবে কি নিয়ে গেছি দেখার জন্য। কিন্তু তাদের জন্য কিছু কেনার সুযোগ কই? ঢাকা থেকে হালুয়াঘাট ৫০০ টাকা, আবার হালুয়াঘাট থেকে গ্রামে যেতে লাগবে আরও ১০০ টাকার মতো। অতিরিক্ত খরচ করার আর থাকে কী?ওমর ফারুক আরও বলেন, মুন্সিগঞ্জ গেছিলাম আলু তোলার কাজ করতে, সেখান থেকে ঢাকায় আসছি। যখন যেদিকে কাজ থাকে, তখন সেদিকেই যাই। কোনোরকমে খেয়ে-পরে বাঁচি। ঈদ তো আমাদের জন্য না, ঈদ বড় লোকদের। আমাদের দিন আসে দিন যায়, কাজ করি, কিছু কামাই করি। কোনোরকমে এভাবেই দিন যায়।
ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করেন এনামুল হক। ঈদে উপলক্ষ্যে যাচ্ছেন নিজ বাড়ি ময়মনসিংহ এলাকায়। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ঈদে বাসের ভাড়া ডাবল হয়ে গেছে। অন্যান্য সময় ২৫০/৩০০ টাকা করে যাই, আজকে ৫০০ টাকার কমে নিবেই না। ১০০০ টাকা নিয়ে বের হইছি। ৫০০ টাকা যদি বাস ভাড়াতেই চলে যায়, পরে আমি কি করব?বাসের টিকিট এখনো কাটিনি। বসে আছি, দেখি কম-সমে যাওয়া যায় কিনা। একটু কষ্ট হলেও যদি ভাড়াটা কম লাগে তাহলে আমার জন্য সুবিধা, যোগ করেন এই যাত্রী।
এনামুল হক আরও বলেন, ঈদ এলে আমাদের মতো গরিব মানুষের হয় যন্ত্রণা। স্ত্রী-সন্তানের চাহিদা, বাড়তি ভাড়া, জিনিসপত্রের দাম বেশি.. সবমিলিয়ে কঠিন অবস্থা। সবকিছু চাহিদার তুলনায় বেশি হলেও আমরা মজুরি বেশি পাই না। প্রায় সময় দুই বেলা খেলে একবেলা না খেয়ে থাকি, প্রতিদিন কাজ মিলে না। এমনও হয় দুইদিন তিনদিন কাজ নাই, দেশে আমাদের থাকার কোনো অবস্থা আছে?
শুধু এনামুল হক আর ওমর ফারুকই নয়, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ করতে নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরুর জন্য এরকম হাজারও যাত্রী জড়ো হচ্ছেন মহাখালী বাস টার্মিনালে। কেউ টিকিট কেটে বাসে ওঠার অপেক্ষা করছেন, কেউবা কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার কেউ এই কাউন্টার থেকে ওই কাউন্টারে যাচ্ছেন একটু কম ভাড়ায় গন্তব্যে পৌঁছানোর খোঁজে।
জানা গেছে, ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত এনা পরিবহনের নিয়মিত ভাড়া ৩৪০ টাকা। অন্যান্য পরিবহনগুলোর মধ্যে সৌখিন পরিবহন, ইমাম পরিবহন, আলম এশিয়াসহ শেরপুর, হালুয়াঘাট, নেত্রকোণা ও ময়মনসিংহের পার্শ্ববর্তী এলাকার বেশকিছু বাস রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এনা পরিবহন ছাড়া ময়মনসিংহগামী প্রায় প্রতিটি বাসই ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করে যাত্রীদের পকেট কাটছে।
এসব প্রসঙ্গে হালুয়াঘাটগামী শ্যামলী বাংলা নামক বাসের কন্ডাকটর মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ঢাকা থেকে হালুয়াঘাট আমাদের নিয়মিত ভাড়া ৪৫০ টাকা, আমরা এখন যাত্রীদের কাছে ৫০০ টাকা চাইলেও তারা মূলত আগের ভাড়া দিয়েই যাচ্ছে। আমরা বেশি ভাড়ায় কাউকে বাধ্য করছি না। মালিকপক্ষ থেকেও নির্দেশ আছে অতিরিক্ত ভাড়া না নেওয়ার জন্য।তিনি আরও বলেন, আমরা কী করব? খুব বেশি যাত্রী পাচ্ছি, এরকম না। একটা বাস পূর্ণ করতে অন্তত ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। আবার এই বাসগুলো ঢাকায় ঢোকার সময় পর্যাপ্ত যাত্রীও পাওয়া যায় না। অধিকাংশ সময়ই ৮/১০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে বাস ঘুরে চলে আসছে।
এনা পরিবহনের (ময়মনসিংহ রোড) সহকারী ম্যানেজার এসএম খালেদ বলেন, সারাবছর আমাদের যে ভাড়া থাকে, ঈদের সময়ও আমরা সেই ভাড়াতেই যাত্রী আনা-নেওয়া করি। শুধু ময়মনসিংহ রোড নয়, অন্যান্য প্রতিটি রুটেই আমাদের ভাড়া স্বাভাবিক সময়েরটাই। এটা আমাদের মালিকপক্ষের নির্দেশ।
তিনি বলেন, ঈদের সময়টা এলে আমাদের জন্য লস। এপাশ থেকে ঠিকই দেখছেন ৪০ জন যাত্রী যাচ্ছে, কিন্তু ওপাশ থেকে বাসটিকে চার জন যাত্রী নিয়েই চলে আসতে হচ্ছে। এরমধ্যে আমাদের তেল খরচ আছে, আমাদের স্টাফদের বেতন দিতে হয়, ঈদ উপলক্ষ্যে তাদের বোনাসও দিতে হবে। অন্যান্য মেনটেন্যান্স খচর তো বাকিই আছে। সবমিলিয়ে ন্যায্য ভাড়া নিতে গিয়ে আমাদের আয়ের তুলনায় ব্যয়টাই বেশি হয়ে যাচ্ছে। তারপরও এনা পরিবহন মানুষের ঈদ আনন্দের কথা চিন্তা করে যাত্রী পরিবহনের কাজটি যথাযথভাবেই করে যাচ্ছে।